ইতিকাফের গুরুত্ব ও অপরিসীম ফজিলত
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
আজ থেকে মহিমান্বিত ইতিকাফ শুরু। মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন সব বাঁধন ছিন্ন করে আল্লাহর ঘরে রহমত ও মাগফিরাতের আশায় পড়ে থাকার নাম ইতিকাফ। এ অবস্থায় শবে কদর লাভ করা সহজ হয়। মা হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রমজানের শেষ দশক উপনীত হওয়ার পর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংসার ধর্ম পালন ক্ষেত্রে সংযম অবলন্বন করতেন এবং ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে নিতেন। সারারাত জেগে কাটাতেন এবং পরিবারের সবাইকে জাগ্রত থাকতে বলতেন। (বোখারী ও মুসলিম)
রমজানের পবিত্রতম দিনগুলিতে পাপমুক্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মহানেয়ামত অর্জিত হয় শেষ দশকের ইতিকাফের মাধ্যমে। ইবনে কায়িম (রহঃ) বলেন, মহান আল্লাহর সঙ্গে আত্মার সুসম্পর্ক গড়ে তোলা জন্য সব ব্যস্ততামুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানমগ্ন হওয়া। পার্থিব সব ধরনের সংশ্রব ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সান্নিধ্যে এসে তাঁর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে খাঁটি নিয়ত ও আন্তরিকতাপুর্ণ ইতিকাফ অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত-এতে সন্দেহ নেই। কারণ, ইতিকাফ জগতের তাবত মায়াজাল ছিন্ন করে নিজেকে মহান আল্লাহর হাতে সমর্পণ করা হয়। একমাত্র তারই ধ্যানে মগ্ন হতে হয়। তাঁর দুয়ারে পড়ে থাকতে হয়। ইতিকাফের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত অপরিসীম।
ইতিকাফ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আঃ)কে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীর জন্য আমার ঘর (বাইতুল্লাহ) পবিত্র রাখতে আদেশ করে ছিলাম। (সুরা বাকারা -১২৫)। ইতিকাফের অশেষ সওয়াব ও সওয়াব সম্পর্কে হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে-ইতিকাফকারী সব গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। সফল সৎ কর্মশীল যত ধরনের সৎ কর্ম করে থাকে, ইতিকাফকারীর জন্য সেসবের অনুরূপ সওয়াব লেখা হয়। (যদি ও সে ইতিকাফের কারণে অনেক নেক কাজ করতে পারেন না)। ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা। সওয়াবের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করাকে শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ তিন প্রকার ওয়াজিব, সুন্নত, নফল। ইতিকাফ মানত করলে তা ওয়াজিব হয়ে যায়। রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। কিছু লোক আদায় করলে সমাজের সকলে দায়মুক্ত হবে। যে কোন সময় অল্প- অধিক যতটুকু সময়ের জন্য হোক ইচ্ছামত মসজিদে প্রবেশের সময় ইতিকাফের নিয়াত করলে নফল ইতিকাফ হয়ে থাকে। এর কোন নির্ধারিত সময়কাল নেই। যে কোন সময় মসজিদে প্রবেশকালে নফল ইতিকাফের নিয়ত করলে মসজিদে অবস্থানের পর নফল ইতিকাফের সওয়াব পাওয়া যাবে। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। দুনিয়ার জীবন অবধি তিনি ইতিকাফ করে গেছেন। দুনিয়ার জীবনের পর প্রিয়নবীর সহধর্মীনিরা ইতিকাফ করতেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, হযরত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু দুনিয়ার জীবন থেকে ইতি হবার বছর ২০ দিন ইতিকাফ করে গেছেন।
রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফের উদ্দেশ্য হচ্ছে। শবে কদরের অনুসন্ধান। কেবল ২৭ রমজান রাতে শবে কদর হওয়া সুনিশ্চিত নয়। শেষ দশকের বেজোড় পাঁচ রাতে শবে কদর নিহিত রয়েছে। একজন মানুষ যতক্ষণ ইতিকাফে থাকে তার পুরো সময়টা ইবাদত হিসাবে গণ্য হয়। যারা ইতিকাফে থাকেন তারা ইবাদতের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে থাকেন। ফলে যে রাতে শবে কদর হয় শেষ দশকে ইতিকাফকারীরা তার ফজিলত পেয়ে থাকেন। শবে কদরের খোঁজে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবাদত করতেন বলে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিকাফের একটি বিশেষ উপকারিতা হচ্ছে মসজিদে অবস্থানের মাধ্যমে সব গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা। হাদিসেও রয়েছে ইতিকাফকারীরা গোনাহ থেকে বিরত থাকে। ইতিকাফ যেন গোনাহ ও পাপ থেকে আত্মরক্ষার মজবুত বর্ম। পুরুষদের মত মহিলারা ইতিকাফ করতে পারেন। বাসায় বাড়ীতে নামাযের নির্ধারিত স্থান তাদের ইতিকাফ স্থল। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মীনিরা নিজ হুজরায় ইতিকাফ করতেন। রমজানে অধিক নেক আমল করা যতনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পাপকাজ থেকে বেঁচে থাকা অধিক গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। আর সে উদ্দেশ্য সফলে ইতিকাফ মুখ্য ভুমিকা রাখে। শবে কদর প্রাপ্তি রমজানের প্রভুত রহমত বরকত ও মাগফিরাত ও নাজাত। অশেষ সওয়াব লাভ এবং পাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামসহ যুগে যুগে পীর, অলি- আউলিয়াগণ তাদের মুরিদ, ভক্ত অনুরক্ত সর্বোপরি পরহেজগার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইতিকাফ করেছেন আশা আগ্রহ নিয়ে। অফুরন্ত সওয়াব অবারিত রহমত লাভের সুবর্ণ সুযোগটি আমাদের কাজে লাগানো দরকার। ইতিকাফ তিন প্রকার এর মধ্যে ওয়াজিব ইতিকাফ হল, নযর মান্নতের ইতিকাফ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি মনস্থ করে যে, আমার অমুক কাজ সমাধান হলে বা অমুক আশা পূরন হলে আমি ইতিকাফ করব। অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ইতিকাফের নিয়ত করে। তবে তার উপর ইতিকাফ ওয়াজিব হয়ে যায়। এবং নিয়তকৃত মেয়াদপুর্ণ করা তার জন্য কর্তব্য। ২.সুন্নত ইতিকাফঃ রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ এ শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনগুলিতে ইতিকাফ করেছেন। রমজানের বিশ তারিখ সন্ধ্যা অর্থাৎ সুর্যাস্তের সময় থেকে তা শুরু করতে হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এর মেয়াদ। এই ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা- এ – কেফায়া। ৩. মুস্তাহাব বা নফল ইতিকাফঃ ওয়াজিব ও সুন্নত ইতিকাফ ছাড়া সব ইতিকাফ মুস্তাহাব। বছরের সকল দিনে এ ইতিকাফ পালন করা যায়। স্বল্প মেয়াদের জন্য হলে ও সকলের ইতিকাফে যাওয়া প্রয়োজন। ইতিকাফের মধ্যে অনেক সওয়াব রয়েছে। খোদ আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফের ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। ইতিকাফের দ্বারা নির্ঝঞ্ঝাটের মধ্যে থেকে এক নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যায়। এ সময়টি মধ্যে কায়মনো বাক্যে কোরআন পাঠ, নফল নামায, যিকির- তছবীহ- তাহলীল, দোয়া-মুনাজাত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একজন মানুষ আত্মশুদ্ধির এক অনন্য স্তরে নিজেকে পৌছাতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান মাসে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসে একটি ফরজের সমতুল্য এবং এ মাসের একটি ফরজ অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমতুল্য। এসব কিছু নির্ভর করে ইবাদতকালে একাগ্রচিত্রতার উপর।
কোরআনে শরীফে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাত্রে ঘুম থেকে জাগা কুপ্রবৃত্তি দমনের একটি কঠোর পন্থা। এবং বক্তব্য হিসেবে সুদৃঢ়। দিনের বেলা তোমার অনেক ব্যস্ততা থাকে। সুতরাং রাতের বেলা তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করো এবং সকল কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র তাঁর দিকেই রুজু হয়ে যাও। উল্লেখ্য যে, মহানবীর দিনের বেলায় কর্মতৎপরতা নবুয়তী কাজের বাইরে ছিল না। তারপরও রাতের গভীরে আল্লাহর প্রতি সম্পুর্ণ রুজু হওয়ার নির্দেশ থেকে একান্ত আল্লাহর ধ্যানের গুরুত্বই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এ মহৎ কাজগুলো মাহে রমজানের মধ্যে বিশেষ করে রাতের অংশে এবং ইতিকাফে ও মহিমান্বিত শবে কদরে অধিক কল্যাণবাহী হয়ে থাকে। আর এমনি করে রোজার অপরিসীম সওয়াব প্রাপ্তিতে ও লক্ষ্য অর্জনে সোনায় সোহাগার মত কাজ করে থাকে। ইতিকাফ খোদাপ্রেমিক রোজাদারের মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবে ফরজ, ওয়াাজিব, সুন্নত ও নফল ইত্যাদি আমলের সওয়াবের অধিকারী ব্যাক্তি সম্পর্কেই সে শুভ সংবাদ প্রযোজ্য হয় যেখানে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি রমজানের রোজা যথারীতি পালন করবে সে যেন সদ্য জন্ম নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মাসুম-বেগুনাহ বান্দায় পরিণত হয়। আল্লামা ইবনে কাইয়েম বলেন, ইতিকাফের উদ্দেশ্য তাৎপর্য হল, আল্লাহর ইচ্ছার সাথে নিজেকে একাকার করে নেয়া। ইতিকাফকারী সব ভুলে গিয়ে প্রভু প্রেমে এত বিভোর হয়ে পড়ে যে, তার সকল ধ্যান ধারণা, চিন্তা ভাবনা একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সংসারের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। এ সম্পর্ক ভালবাসা তার কবরের সঙ্গী-সাথীহীন অবস্থার সহায়ক হবে। ইতিকাফকারীর শয়ন -স্বপ্ন সব কিছু ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে। তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হন। হাদিস শরীফে আছে, যে আমার প্রতি এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার পানে এক হাত অগ্রসর হই। যে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও ইসলামী টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং চেয়ারম্যান – গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।
01718-228446