ঈদুল আজহা ও কোরবানির অর্থনীতি


ড. মো. জামাল উদ্দিন ।।
ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা দেশে এখন জমে উঠছে কোরবানির পশুর হাট। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পশু কোরবানি দেওয়া এই উৎসবের প্রধান উপলক্ষ্য। এই ঈদকে কেন্দ্র করে গবাদি পশু কেনাবেচায় অর্থপ্রবাহ বেড়ে যায় বহুগুণ। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব চলে আসে। সামর্থ্য অনুযায়ী ধনী-গরিব সবাই পশু কোরবানি করেন। ফলে কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা বেড়ে যায় প্রতি বছর। বহু হতদরিদ্র পরিবার তাদের আয় বৃদ্ধি ও পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য কোরবানি সামনে রেখে বহু যতœ-আত্তিতে পশুপালন করে থাকেন। এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয় সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়।
গত ২৬ মে, ২০২৫ এ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি)-এ বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত ‘দেশীয় পশুতে কোরবানি : পশু ও চামড়া ব্যবস্থাপনায় করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, “এবার কোরবানির অর্থনীতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কোরবানি আমাদের আবেগ ও ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে স্থানীয়ভাবে গরু-ছাগল পালনের আগ্রহ বেড়েছে। সময় বদলে যাওয়ায় এখন বাড়ি বাড়ি গরু-ছাগল পালন করছেন নারী খামারি ও উদ্যোক্তারা। এখন কোরবানিতে বাইরের দেশের ওপর নির্ভরতা নেই বললেই চলে। চামড়াশিল্পে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, এবার কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সরকার বিনা মূল্যে লবণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছে। কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হবে।”
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ঈদের আগে পশু কেনাবেচা বেড়ে যায়। গত বছর কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীসহ দেশের বহু জায়গায় ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোতে গবাদি পশু নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েছেন খামারিরা। পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারনে অনেকসময় পশুর দাম বেড়ে যায়। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে কোরবানির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। পবিত্র এ উৎসব বাণিজ্যিক না হলেও অর্থনীতিতে এর অবদান অনেক। পরিবহন ব্যবস্থায় বা ব্যবসায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। এটিও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ মহা কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে লাখো-কোটি মানুষের অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং আয়-রোজগারের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে দেশের জিডিপিও সমৃদ্ধ হয়। সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা যায়, প্রতিবছরের মতো এবারও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেশে কুরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা নিরূপণ করেছে। এ বছর কুরবানিযোগ্য সর্বমোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এবার হৃষ্টপুষ্টকৃত গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতি রয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদিপশুর উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়।
সূত্রমতে, সরকারি নিয়ম অনুসারে প্রতিটি গরু-মহিষ, দুম্বা, ছাগল ও উটের জন্য বিক্রয়মূল্যের ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব দিতে হয়। এবার শুধু ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ থেকেই সরকারের রাজস্ব পাওয়ার কথা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। অন্য পশু মিলিয়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। এছাড়া এ বছর কুরবানি হওয়া ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষের প্রতিটি চামড়ার মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলে এর মূল্য হয় প্রায় ৫৬১ কোটি টাকা। আবার ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়ার প্রতিটির চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৬৮.৫০ কোটি টাকা। প্রতিবছর ঈদুল আজহায় বছরে উৎপাদিত মোট চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশ সংগৃহীত হয়। চামড়াশিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাতগুলোর অন্যতম। আয়ের দিক থেকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের পর দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হলো চামড়া। শিল্প আয়ে এ খাতের অবদান ২ শতাংশ আর রপ্তানির ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশীয় জিডিপিতে চামড়াশিল্পের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ।
কুরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতটি। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়। কুরবানির সঙ্গে চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রপ্তানির জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা গেলে রপ্তানি বাড়বে।
প্রতি বছরের মতো সরকার এবারও ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা সঠিকভাবে প্রতিপালিত হলে কোরবানিকেন্দ্রিক চামড়া বিক্রির সংকট দূরীভূত হবে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়, তার অধিকাংশই হয় কোরবানির সময়। কোরবানির চামড়ার দাম দেশে কম হলেও দেশে-বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশ চড়া। কাঁচা চামড়া পরিবহনে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ থাকলে সুফল মিলবে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে গবাদি পশু পালন করা গেলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব। ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে সরকারের মহতি উদ্যোগগুলো দেশের অগণিত খামারির জীবনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত কোরবানির আদর্শ সফলকাম হবে।
লেখক:কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট।
Email: [email protected]