ধ্বংস ও সৃষ্টির চক্রে বাঁধা এক বাস্তবতা

inside post
– মনোয়ার হোসেন রতন
মানবসভ্যতার ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, ধ্বংস কখনোই চূড়ান্ত নয়। বরং ধ্বংস থেকেই জন্ম নেয় নতুন সৃষ্টি, নতুন দিগন্তের উন্মোচন। প্রকৃতির নিয়মেই প্রতিটি পতনের ভেতরেই থাকে এক নবজাগরণের বীজ। এটি কেবল ইতিহাসের পাতায় লেখা কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়, বরং মানুষের আত্মিক ও সামষ্টিক বিবর্তনেরই একটি চক্র। সময়ের পরিবর্তনে এই ধ্বংস-সৃষ্টির পরিক্রমা বারবার ঘুরে ফিরে আসে, এবং প্রতিবারই মানবজাতি কোনো না কোনোভাবে এক ধাপে এগিয়ে যায়।
রোমান সাম্রাজ্য থেকে ইউরোপের রেনেসাঁ
ধ্বংস ও সৃষ্টির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাসগুলোর একটি হলো রোমান সাম্রাজ্যের পতন। খ্রিস্টপূর্ব ২৭ থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাম্রাজ্য পশ্চিম ইউরোপের বুকে শক্তিশালী একটি ভিত্তি তৈরি করেছিল। কিন্তু ৫ম শতকে ভিজিগথ, হান এবং অন্যান্য জার্মানিক গোষ্ঠীর আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এই পতনের পর ইউরোপে শুরু হয় তথাকথিত ‘ডার্ক এজ’—একটি দীর্ঘ সময়কাল যেখানে শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলার অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়ে।
কিন্তু এই অন্ধকারেই জন্ম নেয় নতুন দিনের সূর্য। ১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যকার রেনেসাঁ বা নবজাগরণ কাল ছিল সেই আলোর নতুন ঊষা, যেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিত্রকলা, দর্শন—সবখানেই ঘটে বিপ্লব। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, গ্যালিলিও, মাইকেল এঞ্জেলোর মতো প্রতিভাবান মানুষরা বিশ্ব সভ্যতার ভিত্তিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেন। এই রেনেসাঁ আমাদের শেখায়—ধ্বংস মানেই পতন নয়; বরং তা ভবিষ্যতের জাগরণে পূর্ব প্রস্তুতি।
বাংলা নবজাগরণ ও ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস এক দীর্ঘকালীন দুঃসহ দাসত্বের প্রতিচ্ছবি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় এই দখলদারিত্ব, যা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার মাধ্যমে শেষ হয়। এই দীর্ঘ সময়কালে ভারতীয় সমাজ, শিক্ষা, শিল্পকলা ও ধর্মজগতে নানা অবক্ষয় দেখা দিলেও, এই শৃঙ্খল থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন চেতনা।
১৮শ শতকের শেষভাগ এবং ১৯শ শতকের শুরুতে বাংলায় সূচিত হয় এক বিশেষ আন্দোলন—বাংলা নবজাগরণ। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক মনীষীর চেষ্টায় ভারতীয় সমাজ এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়। নারীশিক্ষা, বিধবা পুনর্বিবাহ, সমাজ সংস্কার, সাহিত্য এবং জাতীয়তাবোধে এ নবজাগরণ ছিল অনন্য দৃষ্টান্ত। এটি ব্রিটিশ দমননীতির বিরুদ্ধে আত্মজাগরণেরই একটি রূপ, যা একদিন ভারতকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে দেয়।
ফরাসি বিপ্লব ও আধুনিক গণতন্ত্রের জন্ম
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব ইতিহাসের আরেকটি যুগান্তকারী ধ্বংস ও সৃষ্টির উদাহরণ। রাজতন্ত্র, সামন্তবাদ ও চার্চের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে জনগণ। রাজা ষোড়শ লুই এবং রানি মেরি অঁতোয়ানেতকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ফ্রান্সে শুরু হয় গণতন্ত্রের পথযাত্রা। “Liberty, Equality, Fraternity”—এই স্লোগান শুধু ফ্রান্স নয়, বরং সারা বিশ্বকে উদ্দীপ্ত করে। ধ্বংস হয় এক পরাক্রান্ত রাজশাসন, গড়ে ওঠে জনগণের রাষ্ট্রব্যবস্থা।
যুদ্ধ ও মহামারির ধ্বংসেও নবজাগরণ
বিশ্বযুদ্ধ কিংবা মহামারির ভয়াবহতাও ইতিহাসে এমন অনেক ধ্বংস সৃষ্টি করেছে, যা পরবর্তী প্রজন্মকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ নিহত হন। কিন্তু এই ধ্বংস থেকেই জন্ম নেয় জাতিসংঘ, মানবাধিকার ঘোষণাপত্র এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কাতেও, যেখানে একদিকে মৃত্যু, লকডাউন ও ভীতির আবহ ছিল; অন্যদিকে বিশ্ববাসী প্রযুক্তিতে, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এবং সামাজিক সচেতনতায় এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ: একটি বোধের উন্মেষ
সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রেও এই চক্রের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতা কিংবা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা—সবকিছুই এক নতুন চিন্তার দিগন্ত খুলে দেয়। সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলার মতো ক্ষেত্রে প্রতিটি রূপান্তরের পেছনেও থাকে এক অন্তর্নিহিত ধ্বংস ও পুনর্গঠনের বোধ। বিদ্রোহ থেকেই আসে নতুন নির্মাণের ভাষা।
 আশার অঙ্কুর
তাই ইতিহাসের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়—যত বড় ধ্বংসই আসুক না কেন, মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি, বিশ্বাস, এবং স্বপ্ন তাকে আবার জাগিয়ে তোলে। বসন্ত কেবল প্রকৃতিতে নয়, মানুষের চিন্তা, আত্মা ও কর্মেও ফিরে আসে।
এ সময়ের হতাশা, বিভ্রান্তি বা সংকট আমাদের পরীক্ষা করে। কিন্তু যারা এই অন্ধকারের মধ্যে ধৈর্য হারান না, তারাই একদিন হয় প্রবর্তক—নতুন সূর্যের আহ্বানকারী।
তুমি যদি আজ হতাশ হও, মনে রেখো—ইতিহাসের প্রতিটি অন্ধকারেই ছিলো ভবিষ্যতের আলোর বীজ। এবং সেই আলো একদিন তোমার দ্বারেও কড়া নাড়বেই। তোমার বসন্ত একদিন আসবেই।
আরো পড়ুন