আত্মত্যাগ

আনোয়ারুল হক।।

রুমকীর আবদার উপেক্ষা করা গেল না। তাকে সঙ্গে নিতেই হলো রহমান সাহেবের। যদিও বোনকে সঙ্গে নিতে ছোট ভাই প্রবালের প্রবল আপত্তি, ওর কথা,
-‘মেয়েরা কি গরু বাজারে যায় ?’ প্রবালের এই কথাতেই জোর প্রতিবাদ জানিয়েছে রুমকী,
-‘যাবে না কেন ? তোরা যেতে পারলে আমি পারবো না কেন ? মেয়ে হয়েছি বলে ? আমি যাবোই। বাবা, আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি। এই আমার শেষ কথা।’
বাবার আপত্তি নেই বলে প্রবাল শেষ পর্যন্ত মেনে নিল। তবে অনীহাটা তার মন থেকে মুছে গেল না। কেননা, গরুর বাজারের নানা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বোনকে রক্ষা করার দায়িত্বটা তো তাকেই নিতে হবে! তাহলে প্রবালের আর গরু দেখা, পছন্দ করা, দামাদামি করে কেনার মজা পাবার সময় কই ? ডিস্গাসটিং!
মনে মনে রাগ হলেও প্রবাল তার এই ছটফটে বোনটাকে পছন্দই করে। পিঠাপিঠি বলে লাগালাগি যেমন, তেমনি একজন অপরের জন্যে টানও বেশি। অল্পতেই ঝগড়া আবার পাশ ফিরতেই ভাব। ভাইবোনের এই উপভোগ্য সম্পর্ক বহু সংসারে আছে। এজন্যে ওরা যখন কথা কাটাকাটি করে তখন ওদের বাবা রহমান সাহেব কিংবা মা মনোয়ারা বেগম, তাদের মাঝখানে থাকেন না। যে জিতে কিংবা হারে কারো পক্ষে কথা বলেন না।
বরাবর যা হয়, আজও তাই হলো। রুমকীর প্রবল ইচ্ছের কাছে প্রবাল আত্মসমর্পণ করলো।
বেলা তিনটার দিকে খেয়েদেয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে রহমান সাহেব আলাদি গরুর হাটে রওয়ানা হলেন ।
কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই রুমকীর প্রবল চিৎকার প্রবালের মগজ ঢিলে হয়ে গেল,
-‘এ মা! একী! আমার পা, ইস্ ইয়া আল্লাহ…,হেঁ. আব্বু…’ বলে রুমকী দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ডান পা তুলে বাম পায়ে
দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রবাল যেন ভবিষ্যতবক্তা। সে গাড়ি থেকে নেমে দেখেই বললো,
-‘এমনটা যে হবে আমি জানতাম! এই জন্যেই বলেছিলাম..’ ভাইয়ের মন্তব্যে খেঁকিয়ে ওঠলো পর্যুদস্ত বোন,
-‘কচু জানতি তুই, চুপ র্ক! এ্যা মা, এখন আমি কী করবো ? বাবা..’
রহমান সাহেব গাড়ি জায়গামত পার্ক করে নামতে নামতে মেয়ের নাকফাটা আর্তনাদ শুনেছেন। মুচকি হেসে কাছে এসে তার হাত ধরলেন। দেখলেন, রুমকী যেখানে ডান পা জুতোসহ তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে খড়ের স্তূপের নিচে একগাদা গোবর। গাড়ি থেকে নেমে তাতেই পা পড়তে খড়ের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নরম গোবর বের হয়ে রুমকীর জুতোসহ পা চিত্রিত করে দিয়েছে।
মেয়ে বাবার হাত ধরে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে অনতিদূরে রাস্তার কিনারে সবুজ ঘাসে পা জুতো মুছলো। তাতে মোটামুটি চলার মতো হলো। তবে ডান পায়ের তলায় নরম গোবরে ভাব থেকে যাওয়াতে ঠিকমতো পা মাটিতে ফেলা যাচ্ছিল না।
এদিকে গরুর বাজারে ঢোকার জন্যে প্রবালের তর সইছিল না। রুমকীও প্রবালের অস্থিরতা না বুঝে ওর বাম হাত ধরে বললো,
-‘খবরদার, তুই আমার হাত ছেড়ে আগে আগে যাবি না। গরুর হাগা ডান পায়ের তলায় লেগে পা পিছলে যাচ্ছে। আমি হাঁটতে পারছি না।’
দুপুরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ফলে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে আছে। গরু বাজারে এঁটেল মাটি জলে কাদায় একাকার। এই মাটির ওপর দিয়ে হাজার হাজার গরু, ছাগল, মহিষ, উট, ভেড়া এবং ক্রেতা বিক্রেতা মানুষের পায়ের চাপে যা হয়েছে তাতে পা রাখা দায়। হাঁটতে হয় সাবধানে।
সেইসাথে বিক্রি হওয়া বড় ছোট মাঝারি আকারের তাগড়া তাগড়া গরুগুলিকে হাসিল করতে নিয়ে যাওয়ার সময় কেন জানি কেউ হাঁটিয়ে নিয়ে যায় না। না কি অচেনা মানুষ দেখে গরুটাই দৌড়ায় সেই সঙ্গে মানুষও। তখন সামনে পড়লে গরুর শিংয়ের গুঁতো, ঠ্যাংয়ের লাথি, মানুষের ধাক্কা খাওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। আহত হওয়ার মতো যে কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
এই কারণে প্রবাল বোনকে নিয়ে মনে মনে খুব অশান্তিতে আছে। এদিকে আবার রুমকীর বাক্য শুনে সে আরও বিরক্ত। ভাবটা না চেপেই বোনকে চাপা ধমক দিল,
-‘কী বলিস্ তুই ? ওটা হাগা না, গোবর। জানিস্ না তুই ?’ রুমকী ‘ওই হলো, একই কথা’-
বলতে না বলতেই পিছন থেকে-
-‘এই গরু, গরু, সরেন সরেন’ বলতে না বলতেই নাদুস নুদুস, ইয়া মোটা শিংওয়ালা একটা ষাঁড় ধেয়ে আসতে লাগলো ওদের দুজনের দিকে। বিপদ সামনে দেখে রুমকী প্রবালের হাত ছেড়ে দিয়ে ডানে সরে যাবার চেষ্টা করলো। গরুর ধেয়ে আসা দেখে মুহূর্তে আশেপাশের ভিড় জটলা ভেঙ্গে খান খান। লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরবার সময় বেশি পেল না। এ ওর পায়ে পা, ধাক্কাধাক্কিতে প্রবাল একদিকে আর রুমকী অন্যদিকে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো বেঁধে রাখা গরুর খুঁটিতে উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল। সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তবুও হাসছে রুমকী- হি হি হি।
কিন্তু হাসিটা রুমকী ধরে রাখতে পারলো না। ছুটন্ত ষাঁড়ের ভারী নিতম্বের ধাক্কায় এক যুবক ছিটকে এসে ধাক্কা খেল রুমকীর গায়ে। ধাক্কায় এক চক্কর খেতে খেতে রুমকী বিরক্তি ঝাড়লো যুবকের মুখের ওপর,
-‘কী, গরু নাকি! চোখে দেখেন না ?’ যুবক নিজেকে সামলে সোজা হতে হতে হাসি মুখে বললো,
-‘গরুই তো! গরু না হলে কি কেউ গরু বাজারে আসে ? হা হা হা..সবই তো গরু..’
ফিরতি উত্তর দেওয়ার আগেই প্রবাল ফিরে এসেছে দিদির কাছে। চরম ক্ষোভ নিয়ে সে বললো,
-‘এই দিদি, তুই ফিরে গিয়ে গাড়িতে বসে থাক। এই ভিড়ের মধ্যে হাঁটা যায় না আর তুই…’ রুমকী কারো গলগ্রহ হতে চায় না। সে জবাব দিল,
-‘না, যাবো না। বাবা সামনে গেছে যাক্, তুইও যেতে চাইলে যা। আমি হারিয়ে যাবো না। তুই যা, বাবাকে সঙ্গ দে। আমি আছি এখানেই। আমি একাই ঘুরবো।’
প্রবালও যেন এমনটাই চাইছিল। সে এগিয়ে যেতেই রুমকী প্রবালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগল চারিদিক। এ যে বিশাল আয়োজন! অপার বিস্ময়ে দেখছে রুমকী। এতদিন তো টিভিতে আর পত্রিকায় ছবি দেখে ঈদের বাজারে গরু বিক্রির হাট সম্পর্কে ধারণা নিয়েছে। আজ এসে সে যা দেখছে মনে হচ্ছে,
এ তো মহা এলাহী কারবার!
যতদূর চোখ যায় দেখলো, বিশাল এলাকা জুড়ে হাজার হাজার নানা সাইজের নানা রঙের দেশী গরু এবং অন্যন্য কোরবানির পশু। পুরো বাজারে এবারে একটাও ভারতীয় গরু নেই। কী সুন্দর মোটা তাজা গরুগুলি ক্রেতা বিক্রেতাদের দরদামের ভিতর নিবিড় যতœ আর পরিচর্যা নিয়ে কোনটা দাঁড়িয়ে, কোনটা বসে আছে। কোন কোনটি জাবর কাটছে। কোনটি একটা আরেকটার গায় ধাক্কা দিচ্ছে। ভোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সবলটা দুর্বল আরেকটার পিঠের ওপর উঠে যাচ্ছে তো আশেপাশে হৈ চৈ সাড়া পড়ে যায়। সামাল, সামাল রব ওঠে। ক্রেতা বিক্রেতা দর্শনার্থী মানুষের শোরগোল, চিৎকার, তার ওপর পুরো মাঠ জুড়ে একডজনের ওপর বসানো হাসিলের মাইকের ঘোষণা, নির্দেশ সব মিলে এই দেখাটায় রুমকী চরম বিস্মিত এবং উপভোগই করছে বলা যায়।
যুবতীর কৌতুহলী চোখ এখন ডানে বাঁয়ে দেখছে। সামনে নানা লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। রাস্তাটুকু ছাড়া দুইপাশেই ক্রেতা-বিক্রেতা আর গরু সারি বেঁধে রেখে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রুমকী লক্ষ করলো তার ডানপাশে হাত দশেক দূরে পলিথিনের ছাপড়ার নিচে একটি সাত-আট বছরের পানপাতা মুখের শ্যাওলা রঙের একটি মেয়ে মাঝারি সাইজের কালো চকচকে একটি গরুর রশির এক প্রান্ত ধরে খড়ের গাদার ওপর ঘুমাচ্ছে। অপর প্রান্তে গরুটি একটু দূরে আরামের ভঙ্গিতে বসে চোখ বন্ধ করে জাবর কাটছে। এই গরুটি দলের আরও দুটি গরুর মতো রাস্তার নির্দ্দিষ্ট জায়গায় বিক্রির জন্যে বাঁধা নেই। হাবভাব দেখে বুঝাই যায় গরুটি খুব শান্ত।
রুমকী পা পা সেদিকে এগিয়ে যেতেই আশেপাশের জটলার ভিতর থেকে মধ্যবয়ষ্ক পাতলা সাইজের এক লোক, পড়নে চেক লুঙ্গি গেঞ্জি আর কাঁধে গামছা। এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-‘মা, গরু কিনবেন ?’ রুমকী মাথা নেড়ে বললো,
-‘হ্যাঁ, কোনগুলি আপনার গরু ?’
বিক্রেতা লোকটি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মাঝারি সাইজের একটা লাল, একটা সাদা আর ঘুমন্ত মেয়েটির হাতে ধরা কালো রঙের গরুটিকে দেখিয়ে বললো,
-‘এই তিনডা গরু আমার। ঘরে পালা গরু। নেন। পছন্দ করেন।’
রুমকী ঘুমন্ত বাচ্চা মেয়েটির হাতে ধরা গরুটি দেখিয়ে বললো,
-‘ঐ কালো গরুটা আমার পছন্দ। ঐটার দাম কত বলেন।’ বিক্রেতা লোকটা কালো গরুটির দাম না বলে রুমকীকে জিজ্ঞেস করলো,
-‘মা জননী, এই লাল আর সাদার মইধ্যে একটাও আপনের পছন্দ হয় না ?’
রুমকী মাথা নাড়ে। হেসে বলে,
-‘না, আমার ঐ কালো গরুটাই পছন্দ। আপনি দাম বলেন। বাড়ি কোথায় আপনার ? ঐ মেয়েটি কি আপনার মেয়ে ?
রুমকীর প্রশ্ন শুনে গরু বিক্রেতার চেহারায় মেঘের ছায়া পড়লো। নিম্নকন্ঠে সে রুমকীকে বললো,
-‘আমার নাম রমজান বেপারি। গিরস্থ গো মা। আমি এইবারই প্রথম দলের লগে সিরাজগঞ্জ থেইকা আসছি। এই তিনটা গরু আমার ঘরের পালা গরু। ঐডা আমার মাইয়া। মুশকিল হইছে মা গো, আমার ঐ মাইয়া কিছুতেই ঐ কালা গরুডারে বিক্রি করতে দিব না। আমার তো একটাই মাইয়া। খুব আদর করি। হে কয়, গরুডা নিহি ওর ভাই। বাড়ি থেইকা আননের সময় কী কান্নাকাডি, হুলুস্থুল।
তো, হে ও লগে আইবই। কন দেহি, এই কষ্টের মইধ্যে ওরে শেষ পর্যন্ত আনতেই হইলো। এহন ও তো এই গরুডারে বিক্রি করতে দিবই না। আমরা গরিব মানুষ। এই গরু বেচার ট্যাকা দিয়া আমাগো সারা বছরের খাওন খোরাক চলবো। আমাগো সোহাগ দেখাইলে জীবন বাঁচবো ?’
বিক্রেতা লোকটা থামে। রুমকী খেয়ালের বশে গরু দাম করতে যেয়ে যে কাহিনী শুনছে, তাতে তার মন আর্দ্র হয়ে ওঠেছে। কান্না পাচ্ছে। সে জানে, আল্লাহতালা বিধান করে দিয়েছেন, তোমার পছন্দের পশুকে কোরবানি কর। ঐ কালো গরুটি তার পছন্দ হয়েছে। দামও শুনেছে। বাবা ভাই ফিরে এলে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐ বাচ্চা মেয়েটির বুভুক্ষ ভালবাসার কী হবে ?
বিক্রেতা আবার বললো,
-‘কাইল বাদে পরশু ঈদ। এই দুইডা গরু বিক্রির কথা হইতাছে। বেচা হইয়া যাইবো। কিন্তু ঐ কালাডারে কেউ কিনতে আইলেই মাইয়া রশি ছাড়ে না। দেখেন না, রশি ধইরা ঘুমাইতেছে। কাইল এইখানে আসছি পর থেইকা পাহাড়া দেয়, রাইতে এক ফোডা ঘুমায় নাই। আমি যদি ওর ভাইরে বেইচা ফেলি, এইজন্যে!
এইসব কথার মধ্যে প্রবাল আর রুমকীর বাবা পছন্দের গরু আর দাম মিলাতে না পেরে ফিরে আসে। রুমকী ওর বাবা ভাইকে ইশারায় গরুটা দেখিয়ে দিতেই প্রবাল হৈ হৈ করে ওঠে,
-‘বাহ, সুন্দর তো গরুটা! দাম কত ? এই আনেন তো এখানে!’
প্রবালের তীব্র আগ্রহের চেঁচামেচিতে বাচ্চা মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনিদ্রা ক্লান্তিতে চোখ খুলেই যেন বুঝতে পারে সে, জল্লাদ এসে গেছে! মেয়েটি তার বাপের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট্ট দুই হাতে রশির এক প্রান্ত বুকের কাছে চেপে ধরে কান্নাভেজা গলায় চিৎকার করে ওঠে,
-‘দিমু না, দিমু না আমি। বাবা, ওরে আমি বেচতে দিমু না।’
বাচ্চা মেয়েটির কান্নাভেজা চোখের মিনতি দেখে রহমান সাহেব আর রুমকী নির্বাক হয়ে চোখাচোখি করেন। যেন দেখছেন, জীবনের প্রতাপী প্রয়োজনের মুখোমুখি পরাভূত পর্যুদস্ত এক গরু বিত্রেতা আর তার অবুঝ কন্যা, কষ্টের দুটি মুখ, অনাহারে অর্ধাহারে, নিরূপায়।
ওরা জানে, বাস্তবতা বড় নির্মম। তারপরেও সুতীব্র আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে অবুঝ ভালবাসাকে ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা! রুমকীর বুকের ভিতর চিন চিন করে।
প্রবাল এইসব বুঝে না। সে অস্থির। এক্ষুনি সে গরুটি কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায়। রহমান সাহেব তাকে নিবৃত্ত করেন। রমজান বেপারি নিম্নকণ্ঠে বলে,
-‘গরু আমি আপনাদেরই দিমু। তো, এহন নিতে পারবেন না। আমার মাইয়া কান্নাকাটি করবো। ও ঘুমাইলে কাইল মাইঝ রাইতে আইসা নিয়া যাইবেন, আমি কথা দিলাম।’
রমজানের চোখে মিনতির ভাষা। রহমান সাহেব তাকে বিশ্বাস করেছেন। তিনি বিক্রেতার হাতে দুইহাজার টাকা দিয়ে বায়না করে রুমকীর হাত ধরেন। প্রবালের প্রবল আপত্তিকে শান্ত হতে বলে এক মিশ্র অনুভুতি নিয়ে তিনি ঘরে ফিরে এলেন। আসার সময় রুমকী রমজান বেপারির মেয়েটিকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকেছিল। আসেনি সে। আগের মতই শিরদাড়া সোজা করে কালো গরুটার রশির এক প্রান্ত ধরে শক্ত হয়ে খড়ের গাদার ওপর বসেছিল। মন খারাপ রুমকী ভাবতে ভাবতে বাসায় এলো। মনে হলো, জলে ভেজা বাচ্চা মেয়েটির দুচোখ তাদের দিকে তাকিয়ে ঘাতকের চোখ দেখেছিল না কি!
ঈদের আগের রাতে সিরাজগঞ্জে ফেরার পথে রমজান ব্যাপারিদের ফেরত ট্রাকটি আরিচাতে আটকা পড়ে। নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে গত কদিনে ফেরী চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মাত্র একটা ফেরি চলছে খুব ধীরগতিতে। তাই ঈদের দিন সকালেও ট্রাকের আটজন গরু ব্যবসায়ী আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। বেপারির মেয়েটি ফেরার পথে শেষরাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে গরু বেচা হয়ে গেছে জানতে পেরে সেই থেকে অভুক্ত সে।
একনাগারে কান্নাকাটি করতে করতে এখন ট্রাকের পাটাতনে নেতিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে আছে। এক ঢোক পানিও মুখে নেয়নি অভিমানে।
সঙ্গী নিমাই সাহার কাছে মেয়েটিকে রেখে সকাল নয়টার দিকে ঈদের নামাজ পড়তে ঘাটের কাছে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে এলো রমজান। নামাজ শেষে জামাতে মোনাজাতে হাত তুলে আল্লার কাছে কিছুই চাইতে পারে না মানুষটা। হু হু করে কেবল কাঁদে। বলার চেষ্টা করে, পারে না। দরদর করে তার দুই চোখ দিয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। বহু কষ্টে একসময় নিজেকে সামলে নিয়ে রমজান বলে,
-‘মাবুদ গো, পেটের দায়ে আমার বাচ্চা মাইয়ার জানডারে কোরবানি দিয়া আইছি গো মাবুদ, ওর ভাইডারে…’ বলতে বলতে রমজান সেজদায় পড়ে হু হু করে কাঁদে। কান্না সংক্রামক। -‘মাইয়ার আত্মাডারে বুজ দাও মাবুদ!’
রমজানের হাহাকার শুনে অন্য নামাজিরাও যার যার বাসনায় জানা অজানা পাপে অনুতাপে বিগলিত হয়ে কাঁদে।
আর ওদিকে ট্রাকের পাটাতনে ভাই হারা বাচ্চা মেয়েটিও ঘুমের মধ্যে কুঁ কুঁ করে কোঁকায়। অশ্রুহীন কান্নায় ওর ছোট বুক বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে।