শৈশবের কোরবানির ঈদ

আবদুল আজিজ মাসুদ।।
ঈদ মানেই আনন্দ। হোক না রোজার ঈদ কিংবা কোরবানির ঈদ। তবে রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদের আনন্দ উৎসবের মাত্রাটা ভিন্ন। রোজার ঈদের আগমনি বার্তা বয়ে আনে রমজান মাসের শুরুতেই। সারাদিন রোজা রাখা, ইফতার সেহরি খাওয়া, তারাবির নামাজ পড়া, ওয়াক্তের নামাজ মিস না করা। সে যেন এক এবাদতের মৌসুম। এর মাঝে মার্কেটে শপিংমলে ঘুরে ঘুরে পছন্দের জামা-কাপড় কেনা, ঈদের প্রস্তুতি নেয়া ইত্যাদি।
আর ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদে জামা-কাপড় নয়, হাটে হাটে ঘুরে পছন্দ মতো গরু কেনা, গরু দেখা।
এখনো মনে পড়ে সত্তর আশির দশকেও কুমিল্লার চকবাজার ছিল জমজমাট গরু বাজার। এখন যেমন বাজারের একাংশে গরু জমায়েত হয় তখন কিন্তু পুরো বাজার জুড়েই গরু-ভরপুর থাকতো। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই চক বাজারে গরু যাওয়া শুরু হতো। আশপাশের গ্রাম থেকে তো বটেই দূরদূরান্তের গ্রাম থেকেও গরু আসতো এ বাজারে। মোগলটুলী, গাংচরের সড়ক পথেই যেন বেশির ভাগ গরু বাজারে যেতো। আমাদের বাসা শাহ্ সুজা সড়কের পার্শ্বে হওয়াতে বাজারে গরু যাওয়ার এ দৃশ্য বেশ উপভোগ করতাম। অনেকে আবার রাস্তার পার্শ্বে চেয়ার, টুল নিয়ে বসে যেতো গরু দেখার জন্য। শুধু গরু দেখতই না গরু না কিনলেও গেরস্থকে দাঁড় করিয়ে দাম দস্তুর করতো। কেউ গরু কিনে আনলে দাম জানা। জিতে কেনা না ঠকে কেনা মন্তব্য করা। শুধু তা-ই নয় সন্ধ্যায় অবিক্রিত গরু গেরস্থ ফেরত আনলে বাজারে কত মূলিয়েছে তাও জানা। বাজারে গরু যাওয়ার এ দৃশ্য অবলোকনের পাশাপাশি আমাদের সাথের অনেকই কলা গাছের ডগা বা নারকেল গাছের বাইলের পাতা ছড়িয়ে দুই পার্শ্বে সুতলি বেঁধে গরু বানিয়ে ঘুরে বেড়াতো। আশেপাশে বহু বাজার বসার কারণে এখন আর চকবাজার আগের মতো জমে না। তাছাড়া অতিরিক্ত হাসিল আদায়। চড়া দামে গরু বিক্রির বদনাম তো রয়েছেই।
আমাদের গরু কেনার জন্য আব্বাই সবসময় বাজারে যেতেন। আব্বা সাধারণত আশপাশের বাজার থেকেই গরু কিনতেন। চকবাজার বড় বাজার হলেও তেমন একটা যেতেন না। বিশেষ করে শিবের বাজার, দুতিয়ার দিঘির বাজার , নন্দির বাজার থেকেই গরু কিনতেন। আব্বার সাথে বাজারে যাওয়ার জন্য আমরা আগে থেকেই তৈরি থাকতাম। আব্বা ব্যাংকের চাকুরিজীবী ছিলেন। সীমিত আয় এ সংসার চলতো। কখনই বড় গরু কেনা সম্ভব হতো না। শরীকেও কোরবানি দিয়েছেন বহুবার। আমাদের গরুর সাইজ ছিল বরাবরই মাঝারি। এখনও সেই মাঝারি সাইজের গরুই কোরবানি দিয়ে আসছি। তবে গরুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, গরুর সাইজ বাড়েনি। আমাদের ছেলেবেলায় অর্থাৎ ষাট/সত্তরের দশকে ১২০/১২৫ টাকায় আমরা যে গরু কিনতাম সে গরু এখন ৭০,০০০ /৮০,০০০টাকা। আমাদের প্রতিবেশী মজিদ চাচা আমাদের চেয়ে ১০/১৫ টাকা বেশি দামে একটু বড়সড় মোটা তাজা গরু ক্রয় করতেন। এ জন্য আমাদের মন খারাপ থাকতো। আমাদের গরু তাদের মতো তেমন মোটা তাজা হতো না বলে। এ জন্য সম বয়সীদের বিরূপ মন্তব্যও শুনতে হতো।
কোরবানির ঈদে আরো একটা আনন্দ হতো। ঈদের ২/১ সপ্তাহ আগে থেকে বাজারে বাজারে ঘুরে গরু দেখা। কোন বাজারে সবচেয়ে বড় গরু উঠেছে। দাম কত হাকলো। কত টাকা দিয়ে কে কিনলো? এখন তো ঘরে বসে টিভি-ফেসবুক থেকেই এসব জানা যায়। প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরু দেখে কে জিতলো কে ঠকলো মন্তব্য করা, কার গরু কতো সুন্দর, মোটাতাজা, তেজী এসব তথ্য থাকতো নখদর্পণে।
আমাদের মোগলটুলী এলাকায় যারা বড় গরু কোরবানি করতেন এদের মধ্যে ছিলেন এস এ হালিম। যিনি ছিলেন মিঞা হিসেবে এলাকায় পরিচিত। বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। বিশাল গরু আনতেন। গলায় কাগজের ফুলের মালা, মোটা রশি দুই দিকে টানা দিয়ে বাঁধা। আমরা দল বেঁধে দেখে আসতাম। আরো অনেকেই বড় গরু কোরবানি দিতেন। এদের মধ্যে দপ্তরী হাউজের আবু মিঞা, আলাউদ্দিন মিঞা। এখন অনেকেই কোরবানি দিতে পারেন না। আমাদের এলাকায় কয়েকজন মোক্তার মিলে বরাবরই বড় শিং ওয়ালা হালের বলদ বা আবাল গরু কোরবানি দিতেন। গরুর আকার-আকৃতি দেখলেই বলার অপেক্ষা থাকতো না এ গরু মোক্তার সাহেবদের।
আব্বা সুস্থাবস্থায় বরাবরই গরু কিনতে বাজারে যেতেন। আমরা বড় হলে গরু কেনার দায়িত্ব আমার উপরই বর্তায়। ২০১২ সনের নভেম্বর মাসে আব্বা মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর বিবির বাজার থেকে বেশ মোটা তাজা লাল রং এর নেপালী জাতের গরু আনলে আব্বা গরুটা দেখে বেশ বেশ খুশি হয়েছিলেন। আজ আব্বা নেই। আম্মাও ১৯ সালে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গরু দেখে আম্মাও নিরবে ভালো মন্দ মন্তব্য করতেন। এখন আর গরু দেখে মন্তব্য করার আর কেউ রইল না।
আব্বার সাথে ঈদগাহে যেতাম। নামাজ শেষে আব্বার পা ছুঁয়ে ছালাম করে কোলাকুলি করতাম। বাসায় এসে আম্মাকে ছালাম করতাম। এখন আব্বা আম্মা কেউই নেই। থাকে না তাড়াতাড়ি বাসায় এসে আম্মাকে ছালাম করার তাগাদাও । শুধু তাগাদা থাকে কখন আব্বা আম্মার কবর জিয়ারত করতে যাবো।
লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
