এক উরুতে বই অন্যটিতে ইউরিন ব্যাগ!

মহিউদ্দিন মোল্লা ।।
মো. রফিকুল ইসলাম সোহেল। উচ্চতা ৫ফুট ১১ইঞ্চি। ভরাট গলা। আত্মবিশ^াস আকাশচুম্বী। বসে থাকলে তাকে স্বাভাবিক মানুষই মনে হবে। তবে বলিষ্ঠ মানুষটির কোমর থেকে নিচের অংশ দুর্ঘটনায় অচল। শরীরে অর্ধেক হয়ে যাওয়া মানুষটি কাজকর্মে পূর্ণাঙ্গ মানুষকেও ছাড়িয়ে যান। যিনি অন্যের সহযোগিতা ছাড়া গোসলসহ অন্যান্য কাজ করতে পারেন না,তিনি বই নিয়ে ছুটছেন বিভিন্ন সেলুনে। নগরীর বিভিন্ন কার্যক্রমে হুইল চেয়ার নিয়েই উপস্থিত হন। ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেন হুইল চেয়ারে বসেই। তার জীবন যাপন ও পথচলা অনেকে অবাক দৃষ্টিতে দেখেন।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রফিকুল ইসলাম সোহেলের বাসা কুমিল্লা নগরীর দ্বিতীয় মুরাদপুর। ডা. মো. ইদ্রিস মিয়া ও রাবেয়া খানমের ৪ছেলে ও ৩মেয়ের মধ্যে সোহেল ৬ষ্ঠ। তিনি  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন। কুমিল্লা জেলা দল, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় দল ও ঢাকা প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। দুর্ঘটনার আগে কুমিল্লা ইপিজেডের একটি কোস্পানিতে মানবসম্পদ বিভাগে চাকরি করতেন। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই মোটরসাইকেল যোগে ইপিজেডের কর্মস্থলে যাওয়ার পথে অটো রিকশার সাথে দুর্ঘটনায় আহত হন। তার মেরুরুজ্জু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ঢাকা সিআরপি, কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টারের চিকিৎসা ও পরামর্শ তাকে পুনরায় সচল হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।
সরেজমিন নগরীর ২য় মুরাদপুরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে বসে লেপটপে কাজ করছেন রফিকুল ইসলাম সোহেল। দেখে বুঝার উপায় নেই তিনি প্রতিবন্ধী। হুইল চেয়ার নিয়ে পাশে হাউজিং গোল মার্কেটে যান সেলুনে বই দিতে। তার এক উরুর ওপর বই অন্যটির ওপর ইউরিন ব্যাগ। দুই হাতে ঘুরাচ্ছেন হুইল চেয়ার। পথে মানুষের কুশল জানতে চাইছেন, মানুষও হাসিমুখে কথা বলছেন। আলোকিত বজ্রপুর সংগঠনের হয়ে তিনিসহ অন্যরা এরকম ৭টি সেলুনে বই দেন। আরো ৮টি পাঠাগার গড়ে তোলার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।
হাউজিং গোল মার্কেট এলাকার সুপার হেয়ার কাটিং সেলুনের পরিচালক সুজন চন্দ্র শীল। তিনি বলেন,সোহেল ভাই আমাদের এখানে হুইল চেয়ারে চড়ে বই দিতে আসেন। অবসরে কাস্টমাররা বই পড়ে খুশি হন।
সেলুনের গ্রাহক স্থানীয় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন,এখানে ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করি। সুস্থ ও অসুস্থ দুই রুপেই সোহেল ভাইকে দেখেছি। তবে অসুস্থ হওয়ার পরও তার কাজের গতি কমেনি। এটা সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
রফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপের শুরু নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রমকে দেখভাল করার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাপে হুইল চেয়ার নিয়ে ঘর থেকে বের হতে তাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যোগায় আলোকিত বজ্রপুর সংগঠন। এই সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী মাসুদ রানা চৌধুরী, ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর, সুমন ও রুবেল পাল সাংগঠনিক কার্যক্রমে তাকে সম্পৃক্ত রেখে এগিয়ে আসার সুযোগ করে দেন। কুমিল্লা নগরীতে আগে পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিলো। শিক্ষা সংস্কৃতির এই নগরীর সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে তারা পাঠাগার সেলুন চালু করেন। তৃতীয় ধাপে ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা রোকসানা ফেরদৌস মজুমদার, সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর,অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বোলিং কোচ মাহবুব আলী জাকি, গবেষক অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক ব্যক্তিগতভাবে তাকে উজ্জীবিত করেন। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ স্ত্রী শিরিন সুলতানা চৌধুরী, ছেলে সাব্বির আহম্মেদ,মেয়ে রিফা ওয়াসিমা ও ব্যক্তিগত ফিজিওথেরাপিস্ট জীবন কুমারের প্রতি।
তিনি আরো বলেন, প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদেরকে কর্মমূখী করার জন্য আমাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। পরিবারকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
আলোকিত বজ্রপুর সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মাসুদ রানা চৌধুরী বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানবতার দেয়াল,ফুড ব্যাংক,বুক ব্যাংক ও সেলুন পাঠাগার গড়ে তোলেন। এছাড়া খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করেন তারা। রফিকুল ইসলাম সোহেল, ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর, সুমন ও রুবেল পালরা এই কাজ গুলোতে বেশি সময় দেন। তার মধ্যে রফিকুল ইসলাম সোহেল একজন প্রাণবন্ত মানুষ। শারিরীক প্রতিবন্ধকতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি সুস্থ মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন।