এখন আর তিনি অপেক্ষা করেন না

মহসীন কবির।।
আমাদের ৮ ভাই-বোনের মধ্যে দুই আপা মিনুয়ারা ও শাহানার ছিলেন সবার বড়। সেই হিসেবে মায়ের আদর ছাড়াও আপাদের আদর-ভালোবাসাও যথেষ্ট পেয়েছি। অবশ্য আমি বুঝতে শিখার আগেই আপাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তবে ছোট বেলায় মা-বাবার সাথে তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতাম। ছোট আপা ছিলেন শাহানারা। যাকে সবাই ডাকেন শানু নামে। আর বড় আপা মিনুয়ারাকে সবাই ডাকতেন মিনু বলে। ছোট আপার শ্বশুর বাড়ি আমাদের গ্রাম চান্দিনার ফতেহপুরে। বড় আপার শ্বশুর বাড়ি দাউদকান্দির ষোলপাড়ায়। সেখানে আবার আমার নানা বাড়ি। স্বাভাবিকভাবে সেদিকটায় যাওয়ার কথা শুনলে খুবই খুশি হতাম। তাছাড়াও আপা আমাদের অনেক আদর করতেন। আর ভাই-
বোনদের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় তার প্রতি মা-বাবাসহ আমাদের সবার
ভালোবাসা ছিলো অগাধ। বছরের দুইটি ঈদে আমাদের প্রতি আপা এবং তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো একটু বেশি। দেখতাম ঈদের কমপক্ষে ১৫ দিন আগেই আপা চিঠি লিখতেন আমরা কখন ওনার বাড়িতে যাচ্ছি। ভাই-বোনের সবার পোশাকের ব্যবস্থা হচ্ছে তো? বা ওনি কাকে কী দিতে পারবেন? এ নিয়ে যেন ওনার ঘুম নেই। বলে রাখা ভালো আমাদের সবার বড় ভাই ফরহাদ হোসেন তখন ঢাকায় থাকায় তিনিও পরিবারের সবার জন্য পোশাক আনতেন। এরপরও আমাদের নিয়ে বড় আপারও একটি বাজেট ছিলো।
সে অনুযায়ী ঈদের কয়েক দিন আগেই দুলাভাই করিম পাঠানকে পাঠাতেন।
তিনিও আমাদের জন্য ঈদ উপহার আনতেন। অবশ্য বড় মেয়ে এবং বড়
জামাতা হিসেবে তাদের প্রতি মা-বাবারও একটু টান অনুভব হতো। যা আমরা বুঝতাম। এরপর যখন মোবাই ফোনের ব্যবহার শুরু হয়,তখন চাঁদরাতে ভাই-বোনদের কাছে সবার আগে ফোন আসতো আপার। আমরা কখন যাচ্ছি। এটিই ছিলো তার প্রধান জিজ্ঞাসা। আবার আমাদেরও একই ভাবনা কখন যাবো তার বাড়িতে। অবশ্য ছোট আপা শাহানারার বাড়ি কাছে হওয়ায় ঈদের দিন বিকালেই আমাদের পরিবারের সবাই তার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতাম। পরদিনই আমাদের মূল আকর্ষণ দাউদকান্দির বড় আপার বাড়ি। আমি,বড় ভাই ফরহাদ,মেঝ ভাই কাউছার,আমার ছোট মাইন উদ্দিন,আলাউদ্দিন ও আছমাসহ সবাই দলবেঁধে তার বাড়িতে যেতাম। সাথে থাকতেন বাবা-মা। সেখানে গিয়ে তার বাড়িসহ মামা-খালাদের বাড়িতে কয়েকদিন বেড়ানোর পরই
আবার ফিরে আসতাম। এইভাবেই আমাদের ঈদের আনন্দ ষোলকলায় পূর্ণ হতো। আরেকটি দুঃখজনক কথা হলো ব্যক্তিগতভাবে বড় আপার কোনো সন্তান ছিলো না। তাই তিনি আমাদের সব ভাই-বোনকেই সন্তান হিসেবে মনে করতেন। আমার প্রতি ওনার টান ছিলো একটু বেশি। তাই ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই আব্বা-আম্মার কাছে বললেন আমাকে ওনার বাসায় রেখে পড়াশুনা করাবেন। আব্বা-আম্মাও এ ব্যাপারে না করেননি। সে অনুযায়ী একদিন বিকালে দুলাভাই এসে আমাকে নিয়ে যান। সেখানে সুন্দলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই। এসএসসি পাশ করা পর্যন্ত আপার কাছেই ছিলাম। এই কয় বছর ওনি আমাকে সন্তানের মতো আদর-যত্ন করতেন। বন্ধু-বান্ধবদের টানে ঈদে বাড়িতে চলে যেতে চাইলে ওনি মন খারাপ করতেন। এমনও হয়েছে,অনেক ঈদে আমাকে বাড়িতে যেতে দেননি। তার কথা ভেবে আমিও মা-বাবা ছেড়ে ঈদ করেছি। ঈদে তিনি এতটা আদর করতেন,যা ভাই হিসেবে আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়া বলে মনে করি। একটা সময় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য শহরে পাড়ি জমাই। কিন্তু তারপরও ঈদে আমি না যাওয়া পর্যন্ত যেন তার ঈদানন্দ পরিপূর্ণ হতো না। আমিও সবার আগে তার বাড়িতে ছুটে যেতাম। তবে এখন আর আগের মতো ঈদে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করেন না। কারণ ২০১৫ সালে আমাদের সবাইকে ছেড়ে তিনি অনন্তকালে চলে গেছেন। আমরা এখনও যৌথ পরিবার হওয়ায় মা-বাবা, ভাই- ভাবী ও সবার সন্তানরা একসাথে ঈদ উদযাপন করি। পরদিন শামিল হন দুই বোনসহ সন্তানরা। কিন্তু কোথায় যেন একটা শূন্যতা কাজ করে। সবাই আছে। শুধু মায়ের মতো আপা নেই। সত্যি ঈদ আসলেই তার অভাব আমরা অনুভব করি। মহান আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতের আলোয় আলোকিত করুন। এই প্রার্থনা।

লেখক:কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি,ঢাকা ট্রিবিউন।