কুমিল্লার নামকরণের ইতিহাস

 

অনলাইন ডেস্ক।।

 

বাংলাদেশের পূর্ব-আচঁলের বৃত্তকেন্দ্রে কুমিল্লার অবস্থান। গোমতী-তিতাস-এর বিস্ময়কর বালিয়াড়ি এই কুমিল্লা। নদী, দীঘি, খনিজ সম্পদ, বন, পাহাড়, মৃৎশিল্প, খদ্দর, দুগ্ধজাত খাবার, বৌদ্ধবিহার, প্রত্ন নিদর্শন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধস্মারক এবং সুপুরাতন শাসন-রাজরার ইতিহাসে সমৃদ্ধ কুমিল্লা। এই জেলার নামকরণ বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য, চলতিকথা, কিংবদন্তি এবং প্রজন্মপরম্পরার লোকগল্পের সন্ধান পাওয়া যায়, তা বিচিত্ৰমুখী এবং সবল-দুর্বল দ্বিবিধ বৈশিষ্ট্যেই মণ্ডিত।

কুমিল্লার পূর্ব নাম ত্রিপুরা। ইতিহাসে হদিস মেলে ; ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮১ সালে সরাইল পরগনা বাদে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার পুরো অংশ এবং বৃহত্তর নােয়াখালীর পুরো অংশ নিয়ে “টিপারা” জেলা গঠন করে। কালে ঐ টিপারা নামটিই পরিবর্তিত নামোচ্চারণে দাঁড়ায় ত্রিপুরা । জানা যায় ত্রিপুরা নামক একজন প্রতাপশালী রাজার নামানুসারে ত্রিপুরা রাজবংশ পরিচিত হতে থাকে এবং তারই নামে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ হয়। কেউ কেউ সাদামাটাভাবে বলে থাকেন যে, ত্রিপুরা শব্দটি নিকটেরই পাহাড়ী ত্রিপুরা রাজ্যের নাম থেকে এসেছে। কিন্তু নামটির উৎপত্তি অনুসন্ধানীরা এরকম মত পোষণ করেন যে, উক্ত ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন কাহিনী হতে জানা যায়, ঋকবেদ-এর তথ্যানুসারে সপ্ত মহাদেশের সম্রাট যযাতি-র পৌত্র ছিলেন রাজাদের মধ্যে দ্বিতীয়। তার নাম ছিল ‘ত্রিপুরা’। তারই নাম থেকে এই জেলার নামের উৎপত্তি। কেউ কেউ এমন মতামত পোষণ করেন যে, “তুই-প্ৰা” বাক্যটি থেকে ত্রিপুরার উৎপত্তি ঘটেছে। ‘রাজমালা’ গন্থকারের মতে এতদঞ্চলের পাহাড়ী ভাষায় “তুই-প্ৰা” বাক্যের অর্থ হচ্ছে সমুদ্রমুখী’ বা ‘সাগরের দিকে ধাবমান’ । পাহাড়ীরা চলতি দ্রুতকথনে “তুই-প্ৰা” কে তি-পরা, উচ্চারণ করতেন, সেই থেকে ফনোলজিক্যাল উচ্চারণ বিবর্তনে ‘ত্রিপুরা’ শব্দটি এসেছে। তুই-প্ৰা > তুইপ-রা > তিপরা > তিপুরা > ত্রিপুরা। আবার পণ্ডিতবৃন্দের মতান্তরও দেখা যায়। বলা হয় যে, অনার্যদের ভাষা থেকে ত্রিপুরা শব্দটি এসেছে। তারা জলকে বলতো ‘তুই’ । এই তুই এর সাথে ‘প্ৰ’ প্ৰত্যয় যুক্ত হয়ে ‘তুইপ্রা’ শব্দটির উৎপাদ ঘটেছে। তুইপ্রা থেকে তিপ্ৰা > তৃপুরা > ত্রিপুরা এসেছে বলে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে মনে করা হয়। কেউ বলে থাকেন যে, তিন নগরী বা তিনপুর অর্থে ত্রিপুর অথবা ত্রিপুরেশ্বরী দেশ হিসাবেও এই নাম আসতে পারে । আবার এমনও তথ্য আছে যে, ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে জন ডি ব্যবোস অঙ্কিত আঞ্চলিক মানচিত্রে ‘ট্রোপই’ নামক একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই “ট্রোপই’’ই ত্রিপুরা’র আদি শব্দ।

এবার কুমিল্লা প্রসঙ্গ। কিভাবে কখন কুমিল্লা নামটি হয়েছে সেটাই আমাদের প্রধান প্রশ্ন। এতক্ষণের আলোচনায় “ত্রিপুরা’র উৎপত্তিগত উচ্চারণপ্রবাহ ও উৎপত্তির একটি হদিস করা গেলেও এর কুমিল্লা” নামটির কিভাবে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তা বোঝা যায়নি। ত্রিপুরা কিভাবে কুমিল্লা হলো সে বিষয়ে নানারূপ গালগল্প এবং কিংবদন্তির প্রচলন রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে দুর্বল-সবল সবরকমই রয়েছে। তাকে মানা-নামানার ক্ষেত্রে তর্ক-বিতর্কের যথেষ্ট ফোকর ও ভিত্তিও রয়েছে। কথিত আছে যে, চৌদ্দশ শতকের কথা। আহমেদ কবির-এর ভাগ্নে হযরত শাহ্ জামাল। এই শাহ্ জামাল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এতদঞ্চলে আসেন। তিনি যখন যাত্রা করেন, তখন তার মামা আহমেদ কবির তাকে একমুঠো মাটি দিয়ে আদেশ করেন, যেথাকার মাটির রং, গন্ধ এবং স্বাদ এই মাটির সাথে হুবহু মিলে যাবে; সেই স্থানটিকেই যেন শাহ্ জামাল তার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসাবে গ্ৰহণ করেন। এই আজ্ঞাত্ৰত নিয়ে তিনি বহু বন, পাহাড়, সমভূমি অতিক্রম করেন এবং স্থানে স্থানে মামার দেয়া মুষ্টিমৃত্তিকার সাথে মাটির রং, গন্ধ, স্বাদ মেলাতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বর্তমান কুমিল্লা শহরের পূর্বনিকটস্থ গাজীপুর মহল্লার খিলাতলী নামক স্থানে উপস্থিত হন। ভাগ্যবশত এখানকার মাটির-রং-গন্ধ-স্বাদের সাথে তার মামার দেয়া মাটির ঐ ত্ৰিবিধ গুণের মিল লক্ষ্য করা যায়। বহু কষ্টে এই এলাকা পাওয়া মাত্ৰই অনেকটা আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় সফল হবার আনন্দে হযরত শাহ জামাল ‘কোহ মিলা-কোহ মিলা’ বলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন। যার অর্থ ‘কাজিখত পাহাড় (বা উচ্চভূমি) পাওয়া গেছে’। এই “কোহমিলা’ থেকেই নাকি এলাকার নাম রাখা হয় “কোহমিলা’। আর কোহমিলা হতেই কালপরম্পরায় কুমিল্লা” শব্দটির উৎপত্তি ঘটে। কোহমিলা > ক্যোমিলা > কোমিলা >কুমিলা > কুমিল্লা।

অন্য কিংবদন্তি অনুসারে কুমিল্ল নামক একজন শাসকের নামানুসারে এ এলাকার নাম কুমিল্লা হয়। তিনি ষোল শতকে হােসেন শাহ-এর গৌরাধিপতি আমলে, যখন ত্রিপুরার শাসনকর্তা ছিলেন ধনমনিক্য, এই সময় উক্ত কুমিল্ল শাসক হিসাবে এঅঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেন। এমনও জানা যায় যে, এই কুমিল্ল’ শাসক নয়, সেনাপতি ছিলেন।

এ ধরনের আরো কিংবদন্তির প্রচলন আছে যে, দেব ও চন্দ্ৰবংশীয় রাজা পূৰ্ণচন্দ্র লালমাই পাহাড়ে একটি রাজ্যের পত্তন করেছিলেন। যা বর্তমান কুমিল্লার নিকটবর্তী। এইভাবে দ্রুপিয়ান কলিংসও একদা কামালঙ্ক’ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই হেতুতে ধারণা হলো এই কামালঙ্ক’ থেকেই ‘কুমিল্লা” নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকবে। আরো একটি উপকথার মাধ্যমে জানা যায়, এ অঞ্চলে টিপরা (পরে উচ্চারণ পরম্পরায় ত্রিপুরা’ হয়) রাজার স্ত্রীর নাম ছিল “কমলা’। কুমিল্লা” শব্দটি উৎপত্তির মূল বা মা-শব্দ এই ‘কমলা’।

এমনও লোককথা আছে যে, জনৈক ‘করিমুল্লা” নামে এক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি তৎকালের এই পাড়াগ্রাম-এ বাস করতেন। তিনি ছিলেন পাড়াগ্রামটির অধিনায়ক। তৎকালীন শাসন কাঠামোয় পদসোপানপ্রণালীতে এটি ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও সম্মানজনক পদ।। ধারণা করা হয় তিনি তার নামানুসারে উক্ত পাড়াগ্রামের নামকরণ
করেন ‘কুমিল্লা”।

আরো কিছু তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো হলো : বাংলাদেশের পূর্ব অঞ্চলের প্রাচীনকালীন নাম ছিল “কিয়াতস’। কুমিল্লা নামটির প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে গৌরবসমৃদ্ধ মনে করার স্পষ্ট ঐতিহাসিক সামাজবাস্তবতা রয়েছে। চীনদেশের পরিব্রাজক ওয়ান চােয়াং তার মাতৃমাষায় এতদঞ্চলের ভ্রমণ বিষয়ে লিখতে গিয়ে “কিয়ামলঙ্কিয়া” নামী একটি জনপদের কথা উল্লেখ করেছেন। যাকে তিনি বলেছেন সমতট রাজ্যের পূর্ব-দক্ষিণভাগে সাগর তীরের দেশ। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন ওয়ান চােয়াং-এর এই “কিয়ামলঙ্কিয়াই উচ্চারণাঞ্চলিক দোষে পূর্বোক্ত ‘কমলাঙ্ক’ এবং কমলাঙ্ক থেকে ‘কুমিল্লা” রূপ ধারণ করেছে। কমলাঙ্ক নামটির উৎপত্তি বিষয়ে প্রত্নতাত্বিক ও ভাষাতাত্বিক পণ্ডিতেরা কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশের সাথে প্রাচীনকালে কলিঙ্ক রাজ্যের সংশ্ৰব ঘটেছিল। এখানে দ্রাবিড়ভাষীর কলিঙ্গরা একটি রাজ্যের গোড়াপত্তন করে নিজেদের গোষ্ঠীগত নামে তারই নাম দিয়েছিল “কমলিঙ্ক’ । এই নামটি পরে ‘কমলাঙ্ক’ এবং আরো পরে কুমিল্লা’র রূপ ধারণ করে।

১৭৬৫ সালে ঢাকা নিয়াবতের (উপ-প্ৰদেশ) অংশ ছিল কুমিল্লা। ঐ সময়ে দিওয়ানি মঞ্জুরির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র অধীনে আসে এই অঞ্চলটি । তখন অঞ্চলটির দুটি বিভক্তি ছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তৰ্গত ছিল চাকলা রৌশনাবাদ এবং ঢাকার অধীনে ছিল ত্রিপুরা ও নোয়াখালীর অন্যান্য মহাল। ১৭৮১ সালে উক্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টিপেরা বা ত্রিপুরা জেলা গঠন করে। এই জেলায় অধিভুক্ত হয় বর্তমান সরাইল ব্যতিরেকে বৃহত্তর কুমিল্লা এবং বর্তমান বৃহত্তর নােয়াখালী জেলা। ১৭৮৯ সালে, বিশেষত রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত প্রশাসনিক সুবিধাৰ্থ ত্রিপুরাকে স্বতন্ত্র জেলা করা হয়। বৃহত্তর নােয়াখালী এবং বৃহত্তর কুমিল্লা (দ্বীপাঞ্চল, উত্তর ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া এবং আমিরাবাদ ভালুকা ব্যতীত) এই জেলার অধীনে ছিল। ময়মনসিংহ হতে ১৭৯৯ সালে আমিরাবাদ ভালুকাকে কেটে এই জেলাভুক্ত করা হয়। আর ত্রিপুরা জেলা থেকে পৃথক করে নােয়াখালীকে ১৮২২ সালে জেলার মর্যাদা দেয়া হয়। প্রশাসনের অসুবিধা দূরীকরণার্থ ১৮২২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারিতে এক সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৩টি পরগনা (গোপালপুর, ত্রিপুরা, ভুলুয়া, বাবুপুর, জাগদিয়া, জয়নগর, দান্দ্রা, আমিরাবাদ, উমবেরাবাদ, কান্দওয়া, বাদ্রাবাদ, কাঞ্চনপুর ও ষষ্ঠিনগর), ০২টি চাকলা (ঘোষবাগ ও উষাদিয়া), ০২ টি তালুক (বাঞ্ছনগর ও শমসেরাবাদ), ০১টি মহাল এবং জুগদিয়ার কিছু চরাঞ্চলকে নোয়াখালীর সাথে যুক্ত করা হয়। এই ১৮২২ সালেই দক্ষিণ শাহবাজপুর ও কয়েকটি দ্বীপকে ত্রিপুরার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৩০ সালে নোয়াখালী জেলাকে (ছাগলনাইয়া থানা ব্যতীত) ত্রিপুরা হতে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ওদিকে সরাইল, দাউদপুর, হরিপুর, বিজোরা ও বর্তমান ব্ৰহ্মণবাড়িয়া জেলার পশ্চিমাঞ্চলকে ময়মনসিংহ হতে ছেটে ত্রিপুরার সাথে যুক্ত করা হয়। আবার ১৮৭৬ সালে ছাগলনাইয়া, ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়ে যায়।

অন্যদিকে ১৯৬০ সালে ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা স্থাপিত হয়। ১৮৭১ সালে মহকুমা সদর ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া স্থানান্তরিত হওয়ার আগপর্যন্ত ১১ বছর এই ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা সদর ছিল নাসিরনগরে। ১৮৭৮ সালে ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চলের থানাগুলোকে নিয়ে চাঁদপুর মহকুমার গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬০ সালে ০১ অক্টোবরে ত্রিপুরা জেলা নামে অভিহিত হয়ে আসা এই জনপদটি কুমিল্লা জেলা হিসাবে প্রশাসনিকভাবে পৃথকীকৃত হয়