কুমিল্লার ১১জন এমপি কোথায়, কেমন আছেন?

 

আল-আমিন কিবরিয়া ।।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কুমিল্লার এমপি-মন্ত্রীদের। কেউ চলে গেছে বিদেশে। অনেকে দেশে আছেন আত্মগোপনে। একসময় এই নেতারা কাঁপিয়েছেন কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় এলাকা। তাদের ভয়ে একপ্রকার আত্মগোপনে ছিলেন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাসহ নিজ দলের ভিন্ন মতাদর্শীরা।
কুমিল্লার এ এমপি-মন্ত্রীরা ছিলেন তাদের নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনসহ অনুসারীদের অভিভাবক। অভিভাবকরা দেশত্যাগ ও আত্মগোপনে থাকায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিপাকে পড়েছেন।
ছাত্র-জনতা ভেঙে ফেলেছে অনেক এমপি মন্ত্রী বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়। তাদের পাশাপাশি নেতাকর্মীদেরও একই অবস্থা। কুমিল্লার এমপি-মন্ত্রীদের খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে বিমানবন্দর, স্থানীয় জনতা ও একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া গেছে বিভিন্ন তথ্য।
কুমিল্লা-৬, আদর্শ সদরে দীর্ঘ দেড় দশক এমপি ছিলেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক বাহারী সম্রাজ্য। নগরজুড়ে বাহারের ছিল একক আধিপত্য।
শুধু নগরীতে নয় কুমিল্লা জেলায় সবধরনের বৈধ-অবৈধ কাজ, গুম-খুন ও অস্ত্রবাজিসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ছিল বাহারের আধিপত্য। প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এ এমপির নিজস্ব কর্মী বাহিনীর দিয়ে পরিচালনা করতেন এসব কাজ। শেষবার তিনি আলোচনায় উঠে এসেছেন শিক্ষার্থী-জনতার গণ-আন্দোলনে হামলা চালিয়ে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ পর দেশত্যাগের পরপরই সপরিবারে দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে কুমিল্লা-১, দাউদকান্দি-তিতাসে প্রথমবার নির্বাচিত হোন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর ভুঁইয়া। এলাকায় ছিলনা সবুর’কে নিয়ে বিতর্ক। তবে বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলন সবুরের অনুসারীরা ছাত্র-জনতার উপর হামলা চালালে আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। দাউদকান্দি-তিতাস থেকে পাওয়া একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, আবদুস সবুর দেশত্যাগ করতে না পারায় দেশে আত্মগোপনে রয়েছে।
কুমিলার আরেক পরিচিত নাম আবুল কালাম আজাদ। তিনি ছিলে কুমিল্লা-৪, দেবিদ্বারের সংসদ সদস্য। দেড়যুগের বেশি সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগের পর এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন কলাম। এ নেতা ও তার অনুসারীদের কার্যক্রমে বারবার সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা গেছে তাকে। শেষবার গত ৪ আগস্ট দেবিদ্বার সদর এলাকার ১ দফা দাবির গণ-আন্দোলনে আবুল কালাম আজাদ ও তারা ভাই দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদের নেতৃত্ব তাদের হাজারো অনুসারী প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার উপর হামলা চালিয়েছেন। এই হামলায় একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও ৩০ আহত হয়। দেবিদ্বারের একাধিক সূত্র বলেছে, আবুল কালাম আজাদ দেশত্যাগ করে গ্রিসে পাড়ি জমিয়েছেন।

আন্দোলনকালে ঝামেলায় জড়াননি কুমিল্লার মন্ত্রীরা। গণ-আন্দোলনে দেশের পরিস্থিতি টের পেয়ে দেশ ছেড়েছেন আগেভাগে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১০, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, লাঙ্গলকোট ও লালমাইয়ের এমপি আ হ ম মুস্তফা কামাল। ৫ আগস্ট রাত ১২টায় দেশত্যাগ করে সিঙ্গাপুর পাড়ি দিয়েছেন। এর আগে দেশত্যাগ করেছেন
সাবেক রেলমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১১ চৌদ্দগ্রামের এমপি মুজিবুল হকের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে ভেবে ১৬ জুলাই বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে এমিরেটাস এয়ারলাইন্সে (ইকে-৫৮৩) দুবাই চলে যান।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড হিসেবে কুমিল্লায় পরিচত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) সাবেক মন্ত্রী ও কুমিল্লা-৯ লাকসাম মনোহরগঞ্জের এমপি মো. তাজুল ইসলাম। দেশের পরিস্থিতি টের পেয়েছে ২৯ জুলাই দেশ ছেড়েছেন তিনি।  বর্তমানে তাজুল ইসলাম কোন দেশে রয়েছেন এই তথ্য জানেন না কেউ।
কুমিল্লা-৭, চান্দিনার এমপি ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। আন্দোলনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তাল ছিল গোপাল দত্তের চান্দিনা এলাকা। প্রায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা আংশে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার (৩ আগস্ট) দুপুরে  শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সহকারী কমিশনার (ভূমি)’র গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। তারপর প্রাণ গোপাল দত্ত তার ব্যক্তিগত লোকদের মাধ্যমে আন্দোলন প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করলেও সরাসরি তাকে মাঠে দেখা যায়নি। তবে প্রাণ গোপাল দত্তের বিরুদ্ধে গত ৮ মাস ধরে বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজির অভিযোগে এলাকায় তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। চান্দিনা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৩০ জুলাই ভারতে চলে গিয়েছেন গোপাল দত্ত।
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কান্ডারী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। এবার প্রথম কুমিল্লা-৩ মুরাদনগর থেকে নৌকা বিপক্ষে নির্বাচন করে এমপি নির্বাচন হয়েছেন। জাহাঙ্গীরের মুরাদনগরে গণ-আন্দোলনের প্রথম থেকে ছিল উত্তাল। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেছে শান্তিপূর্ণভাবে। কিছুদিন ধরপাকড় করেছে পুলিশ। তবে জাহাঙ্গীরের কোনো অনুসারীরা ছাত্র-জনতার ওপর কোন আক্রমণ করেনি। তারপরেও ২৮ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় ইউএস-বাংলার বিএস-৩০৭ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর চলে যান তিনি।
কুমিল্লা ৮, বরুড়ার এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। তিনি ব্যবসায়ী। এবছর আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমবার নির্বাচিত হন। বরুড়ায় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও দেশত্যাগ করেছেন। ১৭ জুলাই রাত ১১টা ৫০ মিনিটে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে (সিজেড-৩৯১) চীনের গুয়াংজুর উদ্দেশে দেশ ছাড়েন তিনি।

২৫ জুলাই বেলা ১২টা ১০ মিনিটে ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন কুমিল্লা-৫ আসনের এমপি এ এম জাহের। এই সংসদ সদস্য উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগের পর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

কুমিল্লা-২, হোমনা ও মেঘনার এমপি ও হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ। এবছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের এলাকা থেকে পাওয়া সূত্রে জানা গেছে, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তিনি তার ঢাকার একটি বাড়িতে অবস্থান করছেন।