কুমিল্লায় মহাসড়কের পাশে রেস্তোরাঁর ফাঁদ!

 

আবদুল্লাহ আল মারুফ ।।
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন ফয়সাল রহমান। চাকরির সুবাদে মাসে দুই থেকে তিনবার তিনি ঢাকা-চট্রগ্রাম রুটে যাত্রা করেন। একটি জনপ্রিয় বাস সার্ভিসে তিনি রাত ১১ টায় রওনা হন। সকাল ৮ টায় বাসটি এসে যাত্রা বিরতি করে কুমিল্লা শহরের নিকটবর্তী একটি হাইওয়ে হোটেলে। এসময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। সেখানে খাবার খেতে বসে খাবারের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ফয়সালের মতো হাজার হাজার যাত্রী প্রতিদিন এই রুটে যাত্রা করেন। যার অধিকাংশই বিরতির স্থান হিসেবে কুমিল্লা অংশের হাইওয়ে হোটেল গুলোতে খাবার খান। অনেকে বাধ্য হয়ে খাবার খেতে হয় আবার অনেকে সামান্য নাশতা করেই চালিয়ে নেন। তবে হোটেল গুলিতে সামান্য নাশতার খরচ আর শহরের কোন রেস্তোরাঁয় ভালোভাবে পেট পুরে খাওয়ার খরচের সমান।
এমন অন্তত ১০ জন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। প্রত্যেকের অভিযোগ, সাধারণ রেস্তোরাঁর তুলনায় এখানে খাবারের দাম দুই থেকে তিন গুণ বেশি হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের একটি হোটেলের কর্মচারী মোবারক হোসেন খান। তিনি বলেন, হাইওয়ের হোটেল গুলোতে আমার যাওয়া আসা নিয়মিত। কারণ আমি কুমিল্লা হয়ে আমার বাড়ি চাঁদপুরে যেতে হয়। এই হোটেল গুলোতে দাম একটু বেশিই রাখতে হয়। কিন্তু তারা যা রাখছে তা অনেক বেশি। কোথাও কোথাও দুই তিন গুণও বেশি। এটা একটা জুলুম বলা চলে।
তিনি আরও বলেন, আমি যেহেতু হোটের রেস্তোরাঁর লোক। আমি জানি এগুলোর কত বড় সিন্ডিকেট। তারা বাস মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে। এসময় তিনি দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন, এই বাস গুলো শুধু এই রেস্তোরাঁতেই আসবে। অন্য কোথাও যাবে না। কেন অন্য রেস্তোরাঁয় কি খাবার নেই?
একই কথা বলেন, ঢাকাগামী একটি বাসের আরেক যাত্রী শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, ১৩বছর পর বিদেশ থেকে এসেছি। আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছি। দেশে থাকা অবস্থায় যখন যেতাম তখনও এই হোটেল রেস্তোরাঁ গুলোর খাবারের দাম অনেক বেশি ছিল। এখনও তাই। এগুলো ঠিক হবেনা।
জানা গেছে, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ১০৫ কিলোমিটার অংশ। এই এলাকা জুড়ে সড়কের পাশে নান্দনিক আয়োজন করে দাঁড়িয়ে আছে ৭০টির বেশি হাইওয়ে হোটেল ও রেস্তোরাঁ। তাদের ক্রেতা চলতি পথের যাত্রী। কোনটি আবাসিক আবার কোনটি শুধুই খাবার হোটেল। এসব রেস্তোরাঁয় দৈনিক গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার খাবার বিক্রি হয়।
বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে ঘুরে, বাস চালক ও সহযোগী, যাত্রী, হোটেল মালিক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হোটেল রেস্টুরেন্টের মালিকদের সঙ্গে পরিবহন মালিকদের একটি অলিখিত /মৌখিক চুক্তি হয়। এতে বলা হয় হোটেলে যদি তার পরিবহন যাত্রাবিরতি করে তার জন্য তাকে একটি টোকেন মানি দিতে হবে। মাঝে মধ্যে তা বাস চালক ও চালকের সহযোগীদের খাবার বিনিময় অথবা মাসিক চাঁদাতেও হয়ে থাকে। অনেক সময় হোটেল প্রতিষ্ঠার সময়ই বড় ও দূরপাল্লার পরিবহন মালিকদের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। তাই কাস্টমার পেতে আগেই ভাগেই আর্থিক লেনদেন সেরে ফেলতে হয়। এতে করে আর্থিক বিনিয়োগের ভাগ পড়ে ভোক্তাদের ওপর। তাই হোটেলের খাবারের মূল্য বাড়িয়ে তাদের বিনিয়োগ উসুল করেন মালিকরা। কড়ায় গ-ায় যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ যাত্রীদের।
অনেক মালিকের দাবি, হাইওয়ে হোটেলে যাত্রা বিরতির পরিবহন ছাড়া কোন কাস্টমার নেই। আর অপরদিকে কোন হোটেলে ২০জন থেকে ১০০জন পর্যন্ত কর্মকর্তা কর্মচারী আছে। তাদের খাবার দাবার থেকে বেতন সবই দিতে হয় মালিককে। তাই দাম বেশি রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই।
হাইওয়ের হোটেল রেস্তোরাঁ ও শহরের হোটেল রেস্তোরাঁ গুলোর দামের তফাত অনেক। শহরের রেস্তোরাঁয় সাধারণ আলুর ভর্তার দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা, শুটকি ভর্তা ২০ থেকে ২৫ টাকা, গরুর মাংস ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, মাছ ৮০ থেকে ১২০ টাকা, খাসির মাংস ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, মুরগির মাংস ৮০ থেকে ১২০ টাকা, সবজি ২০ থেকে ৩০ টাকা। অপরদিকে হাইওয়ের হোটেলের ভর্তা বিক্রি হয় ৪০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত, রান্না করা গরু মাংস ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, মুরগির মাংস ২২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত, মাছ ২২০ থেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও এসব খাবারের ভিন্নতায় দামের ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়।
কুমিল্লা জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাছিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এক একটা রেস্টুরেন্ট মালিককে একটা বাস রেস্টুরেন্টে থামানোর জন্য প্রতি মাসে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। সেই বাসের ৩ জন স্টাফকে নিয়মিত খাওয়াতে হয়। এজন্যই মূল্য বেড়ে যায়। তার ওপর যাত্রীদের ওয়াশরুম ব্যবহার, সেগুলোর বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল দিতে হয়। আমাদের কর্মচারীদের বিল দিতে হয়। সরকার যদি পলিসি নিতো, কোন রেস্টুরেন্টে কতটা দাঁড়াবে অথবা বাসগুলো এই বাবদ কোন টাকাপয়সা নিতে পারবে না, তাহলে এই মূল্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকতো।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কুমিল্লা জেলার সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, যারা থামে সেগুলো আন্ত জেলার বাস সার্ভিস। বাস মালিকদের সঙ্গে তাদের একটা চুক্তি থাকে। যোগাযোগ করেই তারা হোটেল গুলাতে থামে। এই বিষয়ে তারা বলতে পারবে।
কুমিল্লার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. আছাদুল ইসলাম বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেনা। প্রশাসনের সঙ্গে হোটেল রেস্তোরাঁ মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে যে দাম নির্ধারণ করা হয় তার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। কোথাও নির্ধারিত দামের বেশি নিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। যদি কোথাও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করা হয় তবে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, হোটেল রেস্তোরাঁর দাম নিয়ে কোন অভিযোগ পাইনি। যদি কোন হোটেল রেস্তোরাঁ মূল্যে অনিয়ম করে থাকে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।