কুমিল্লা মহাসড়কে বিশ্বরোডের মালা!

 

গ্রাম হয়েছে শহর, আছে যানজট যন্ত্রণা
আলেখারচর, জাগুরঝুলি, কোটবাড়ি, বেলতলী ও পদুয়ার বাজারের জন্ম কথা
আবদুল্লাহ আল মারুফ ।।
সেবার নামে খোলা প্রতিষ্ঠান থেকেই এক নতুন অর্থনীতির যাত্রা। গ্রাম হয়ে যায় শহর। এভাবেই শত গল্পের গাঁথুনিতে গেঁথে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের বিশ^রোড এলাকা গুলো। এখানে সমৃদ্ধির সাথে আছে যানজটের যন্ত্রণা। ফুলের মালার মতো মহাসড়কের গলায় মালার মতো গেঁথে আছে বিশ্বরোড গুলো।
প্রবীণ বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী লেনে ক্রমান্বয়ে আলেখারচর বিশ^রোড, জাগুরঝুলি বিশ্বরোড, কোটবাড়ি বিশ্বরোড, বেলতলি বিশ্বরোড ও পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড। বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে কলকাতা, কানপুর, দিল্লি, ভারতের অমৃতসর হয়ে পশ্চিমে পাকিস্তানের লাহোর, গুজরাট, রাওয়ালপিন্ডি এবং পেশোয়ার কাবুল, আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল একটি সড়ক। নাম তার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা ‘জি টি রোড’। এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক পথটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে আলেখারচর হয়ে কুমিল্লা শহরের বুক চিরে সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী (তৎকালীন সুয়াগঞ্জ) গিয়ে মহাসড়কে মিশেছে। ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান শাসক আইয়ুব খান এসে এই সড়কের একটি নতুন রূপরেখা করেন। যেখানে কুমিল্লার আলেখারচর হয়ে শহরে না প্রবেশ করেই সোজা রাস্তায় কুমিল্লার কোটবাড়ি বিশ্বরোড ও পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড হয়ে সুয়াগাজী মিশবে। এর পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সরকার কাজের উদ্যোগ নেন। শেষ করেন এরশাদ সরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রদক্ষিণ করা এই মহাসড়কের নাম বিশ্বরোড হিসেবে পরিচিতি পায়। নতুন করে যুক্ত মহাসড়কের এই অংশকে স্থানীয়রা দ্রুত পরিচিতি দেয়ার জন্য এবং পুরনো সড়ক বাদ দেয়ার জন্য এর নাম দেন বিশ্বরোড। তাই মহাসড়ক লাগোয়া এসকল স্টেশনের নামই কালক্রমে বিশ্বরোড যুক্ত হয়ে যায়।
আলেখারচর বিশ্বরোড
আলেখারচর বিশ্বরোডকে বলা হয় কুমিল্লার প্রথম প্রবেশমুখ। বৃটিশ শাসনামল থেকে আজ অবধি আলেখারচর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কুমিল্লার বিশ^রোড এলাকার শুরুও এখান থেকে। আলেখারচর কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়কে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যুক্ত করেছে। যেকারণে যাত্রী উঠানামায় পদুয়ার বাজারের পর এটি কুমিল্লার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম। তাই ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী বাসের বেশিরভাগেরই এই স্টেশনে থাকে বিশেষ নজর।
এই আলেখারচর এলাকাটির নাম হলেও মহাসড়কের এই অংশকে জনতা অন্য নামে চিনতো। এছাড়াও কোন ঘরবাড়ি বা দোকানপাট না থাকায় এই এলাকা ছিল সুনসান নীরব। তাই ডাকাতের উৎপাতও বেশি ছিল।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে আলেখারচর এলাকায় ব্যবসা করা স্থানীয় বাসিন্দা মুন্সি মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ১৯৯৮ সালের দিকে এখানে গাড়ির পার্সের দোকান দেই। তখন আমি ছাড়া আর হাতে গোণা দুই তিনটি দোকান ছিল। আলেখারচর এই এলাকার নাম হলেও তখন এই স্টেশনের নাম ছিল বিরতি বিশ্বরোড। এখানে বিরতি নামের একটি হাইওয়ে হোটেল ছিল। ৯৮ এর আগে এটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে এর নামকরণ হয় আলেখারচর বিশ্বরোড।
তিনি বলেন, এই জায়গাটায় তেমন দোকানপাট ছিল না। তাই নীরব এলাকা ছিল। এখানে ডাকাতের উৎপাতও বেশি ছিল। আমার চোখের সামনে কত ঘটনা ঘটেছে! তখন আমরা সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতাম। এখন এই এলাকা সমৃদ্ধ। এখানে রাতদিন মানুষ থাকে। প্রতিদিন এই এলাকায় কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য হয়। এখন ডাকাতও নেই আর আতঙ্কও নেই।
আলেখারচরের আরেক পরিচিতি হলো ‘যুদ্ধ জয়’ ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জয়ের সেই মহাক্ষণ ধরা হয়েছে ‘যুদ্ধ জয়’ ভাস্কর্যে। কুমিল্লা শহরের প্রবেশমুখে এই আলেখার চর বিশ্বরোড এলাকাতেই স্থাপিত হয়। অস্ত্র হাতে এক নারীসহ চার মুক্তিযোদ্ধার জয়ের উদযাপন নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ভাস্কর্যে। এর জন্যেও এই স্থানটি সমধিক পরিচিত।
জাগুরঝুলি বিশ্বরোড
জাগুরঝুলি নাম শত বছর ধরে প্রচলিত। এই নামের উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়না। তবে এই বিশ্বরোড এলাকায় নামকরণের আছে ভিন্ন এক গল্প। কথা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ শুরুর সময় থেকে ব্যবসা করা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে। একসময় ছিলেন স্বাস্থ্য সহকারী। পরে নিজেই ৯০এর দশকের স্থানীয় জনগণের সেবা করতে একটি ফার্মেসি খোলেন। সে সময় জাগুরঝুলি এলাকা ছিল সুনসান নীরব। দীর্ঘক্ষণপর পর একটি দুটি বাস যেত। দেশ স্বাধীনের পর জাগুরঝুলি এলাকার এমপি ছিলেন আবদুল মালেক। উনি বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতের সুবাদে এই এলাকার পরিচিতি পায়। তখন কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে পাশের বরুড়া উপজেলার রামমোহন পর্যন্ত যাতায়াতের বাস ছিল। যখন এই বিশ্বরোড নতুন হয় তখন আমরা ছোট, তবে মনে আছে। আমরা কেউই বিশ^রোড বলতাম না। তখন রাস্তা পার হতে গিয়ে অনেক গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়তে থাকে। পরে সবার সিদ্ধান্ত হয় এখানে একটা স্টেশন হবে। শহরের মানুষ এখানে এসে নামবে। এখান থেকে মহাসড়কের মানুষ শহরে যাবে।
আমরাও নিজেদের এলাকা আরও বড় করে তুলে ধরার জন্য জাগুরঝুলি বিশ্বরোড বলতে থাকি। কান্দিরপাড় থেকে কোন অটোরিকশা, রিকশা বা সিএনজি আসার সময় জাগুরঝুলি বিশ্বরোড বলেই উঠাতো। এভাবেই শুরু হয় জাগুরঝুলি বিশ্বরোডের যাত্রা। কথা বলার একপর্যায়ে গলা ভারি হয়ে আসে আবদুল কুদ্দুসের। সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেছে কত প্রিয়জন। তার মধ্যে আছে তার বড় ছেলে শাখাওয়াত হোসেন ও মামা আবদুল মালেক।
কোটবাড়ি বিশ্বরোড
কোটবাড়ি নাম শুনেনি এমন মানুষ কুমিল্লা নয় সারাদেশে খুঁজে পাওয়া ভার। শিক্ষা, সংস্কৃতি আর পর্যটনে লালমাই পাহাড়ের এই পাদপিঠের পরিচিতি সুদূর প্রাচীনকাল থেকে। কিন্তু একসময় এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নাজুক। পরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হওয়ার পর বদলে যায় এই এলাকার চিত্র। কোটবাড়ির বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) জন্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে যায় এর খ্যাতি। এছাড়াও শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর এই অঞ্চলকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তবে মহাসড়কের এই অংশের নাম ছিল একসময় নন্দনপুর। যেসকল যাত্রী দূর থেকে আসতেন তারা বাস চালককে বলতেন কোটবাড়ি নামবেন। তখন বাস চালকের সহযোগী কোটবাড়ি এলাকার কাছাকাছি আসলে চিৎকার করে বলতেন ‘কোটবাড়ি বিশ্বরোড, কোটবাড়ি বিশ্বরোড, কোটবাড়ি বিশ্বরোড’। এভাবেই নাম হয়ে যায় কোটবাড়ি বিশ্বরোড।
৩২ বছর কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় ব্যবসা করা মো. আবদুল আউয়াল এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এলাকার সমৃদ্ধির যাত্রা আমাদের চোখের সামনে। এই এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ বাইরে থেকে আসা। কিন্তু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তখন আমাদেরটা ছাড়া আর কোনটাই ছিলনা। এরপর একটি দুটি করে গড়ে উঠতে থাকে। আর এখন শহরের স্বাদ পাচ্ছে এই এলাকার আশপাশের গ্রামের মানুষ। এই এলাকা সড়ক দুর্ঘটনার জন্যও ছিল প্রসিদ্ধ।
বেলতলি বিশ্বরোড
বেলতলি বিশ্বরোডের যাত্রা সম্প্রতি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিশ্বরোডের পরিচিতি হতে শুরু করে। কারণ বিশ্বরোডের বাস ও পরিবহন গুলো বেলতলি দিয়ে শহরে যাওয়া আসা করে। সম্প্রতি সরকার বেলতলি হয়ে বিশ্ববিদ্যায়ের যাতায়াত আরও সহজ করতে একটি আন্ডারপাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার কাজ এখনও চলমান রয়েছে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরেই বেলতলি বিশ^রোড হিসেবে বেশি পরিচিতি পায়।
পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড
পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড। সারা বাংলাদেশের সঙ্গে কুমিল্লা ইপিজেড তথা কুমিল্লা অঞ্চলকে যুক্তকারী চৌরাস্তা। বলা হয় পদুয়ার বাজারের সৃষ্টি হয়েছে কুমিল্লাকে সৃষ্টির জন্য। অনুমান করা হয় পদুয়ার বাজার এলাকার বড় একটি পুকুর ছিল। সেই পুকুরে ছিল শত শত পদ্মফুল। বৃটিশ আমল থেকে চলা এই বাজারের নামকরণ এই পদ্মফুলের থেকেই। তবে এই বাজারের নাম করেণের আসল ইতিহাস জানা নেই বাজারের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যবসায়ীরও।
নাম তার আবদুল গণি ভূইয়া। বাবা আশু ভূইয়া। আর দাদা পদুয়ার বাজার এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব হাজী আক্রাম উদ্দিন। যার নামে পদুয়ার বাজার এলাকার তথা কুমিল্লার পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাজী আক্রাম উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ। দুই প্রজন্মের গত হওয়ার পর ভূইয়া পরিবারের ঝান্ডা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আবদুল গণি ভূইয়া। তার সঙ্গে কথা হয় পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় তার বাবা-দাদাদের জমিতে দাঁড়িয়ে। বলেন বিশ্বরোডের সৃষ্টির ইতিহাস। এরশাদ আমলে পুরোদমে শুরু হয় মহাসড়কের এই অংশের কাজ। তখন শ্রমিকরা এই এলাকায় কাজ করলেও তাদের খাবার খেতে যেত হতো অনেক দূরে। তখন আমি টিনের একটি ঘরদিয়ে পাইকারি দরে মালামাল বিক্রি শুরু করি। এই এলাকায় এটি ছিল প্রথম দোকান। তাই আশপাশের উপজেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে মালামাল নিতে শুরু করেন। আর আমিও অল্পদিনে ব্যবসা দাঁড় করানোর সুযোগ পাই। অপরদিকে যাদের দেখে এই ব্যবসা শুরু করলাম শ্রমিকদের সবাই আমার ক্রেতা হয়ে উঠে। বেশ কয়েকবছর নাগাদ কাজ শেষ হওয়ার পর জমতে শুরু করে পদুয়ার বাজারের নতুন অংশ পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড। এখনও শত বছরের নিয়মে বৃহস্পতি ও রবিবার চলে পদুয়ার বাজার। আর নতুন করে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড জমে থাকে সারাবছর।
তিনি বলেন, পুরো বাজারের বেশিরভাগই আমাদের সম্পত্তি। কিন্তু আমরা এই বাজারের ঐতিহ্য হারাতে দেইনি। দাদার নামে করা স্কুলের সামনে বসে পুরাতন পদুয়ার বাজার। আর নতুন বাজার আরও সামনে। পুরোটাকেই এখন বলে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড। তবে এর অগ্রযাত্রা ২০০০ সালের পরে। এখনকার লম্বা লম্বা ভবন গুলোর সব গুলোই ২০০০ এর পরে। এখন বিশ্বরোড এলাকায় দেশের সব ব্যাংকের শাখা আছে। সব প্রতিষ্ঠানের শাখা বা উপশাখা আছে। দিনে এখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। পদুয়ার বাজার এখন বিশ্ববিখ্যাত এলাকা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে আরেক প্রবীণ ব্যবসায়ী বলেন, দীর্ঘদিন এখানে ব্যবসা করি। এখানকার অনেক স্মৃতি আছে। পূর্বে বিশ্বরোড এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ যানজটে আটকে থাকতো। এখন ওরকম নেই। তবে রাস্তার মাঝে অবৈধভাবে বাস ও অন্যান্য পরিবহন পার্কিং করে রাখাতে মাঝে মাঝে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। যেকারণে আমরাও ভোগান্তি পোহাতে হয়। আর যাত্রীদের কথা কিইবা বলবো।
পদুয়ার বাজারসহ আশপাশের এলাকায় অবৈধ পার্কিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ময়নামতি হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল বাহার মজুমদার। তিনি বলেন, আমরা গত সপ্তাহেও অভিযান করেছি। মামলা দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। আমাদের পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) মহোদয় এসব বিষয়ে খুবই কঠোর। তিনি এসে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। উনি অনেকবার বাস মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বসেছেনও। তাদের অযুহাত এই এলাকায় কোন পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। তারা এসব অভিযোগ দিয়ে গাড়ি রাখছেন। আমরা এই বিষয়ে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। যেকারণে সম্প্রতি বার বার টহল দিয়ে সড়কটি খালি রাখার চেষ্টা চলমান রয়েছে।