কুশিয়ারা নদীর ঘাটে সেই বেঁদে নৌকার স্মৃতি

 

।।   মাছুম মিল্লাত মজুমদার।।

               আমি খুব ব্যস্ত মানুষ নই, বলতে পারেন আয়েশি বা আলসেভরা একজন। তাই একেবারে শেষ মুহুর্তে কলম ধরেছি। পত্রিকায় ছাপানোর  হয়তো সুযোগ হবেনা।

এখন রাত ১১টা বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই। কয়েকঘন্টা পর  আরাফার দিন শুরু হবে,অর্থাৎ পবিত্র হজ্জের দিন। এ বছর আরাফার দিনটি শুক্রবার পড়েছে, তাই এবারের হজ্জের দিনটি অনেক তাৎপর্যর্পূণ। বছরের শ্রেষ্ঠ দিন আরাফার দিন, অন্যদিকে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠদিন শুক্রবার, আরাফার দিন দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময় ,তাই এবারের হজ্জের দিন নিশ্চয়ই মহান সৃষ্টিকর্তা হাজী সাহেবদের দোয়া কবুল করে নিবেন। পাশাপাশি আমরা যারা গুণাহগার বান্দা আমাদেরকে হেদায়াতের জন্য তালিকায় নাম উঠাবেন। শুনেছি আরাফার দিন রোযা রাখলে  পূর্ব ও পরবর্তী ১ বছরের গুণাহ মাফ হয়।

তাছাড়া আরাফার দিনে—  “ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আ’লা কুল্লে শাইয়্যিন ক্বাদির। “ দোয়াটি পড়লে অনেক ছওয়াব পাওয়া যায়।

আরবি জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আযহা।  হিসেবমতে আমাদের দেশে ঈদুল আযহা উদযাপিত হবে ইংরেজি জুলাই মাসের  ১০ তারিখ। সংখ্যাগত মিল যদিও কোন তাৎপর্য  বহন করেনা, তবুও আমি গুণাহগার   বিষয়টিকে এভাবে ভাবতে পারি,সৃষ্টিকতা  এ ডাবল ১০ সংখ্যাকে আমাদের জন্য ডাবল ডাবল বরকত হিসেবে কবুল করেন,করতেও তো পারেন।

মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা।মহান সৃষ্টিকর্তা মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম আঃকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। প্রিয় নবী সেই কঠিন পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তখন থেকে শুরু হয় পশু কুরবানি।

পশু কুরবানির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছেন,আমরা যেন আমাদের অন্তর থেকে হিংসা,বিদ্বেষ,জিঘাংসা,বিকৃত মনোবৃত্তি,পাশবিক আচরণ দূর করে আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ,পবিত্র করে নিতে পারি।

কুরবানির এ শিক্ষা বর্তমান সমাজে অতীতের চেয়ে আরো বেশি অনুভূত হচ্ছে। কেননা সমাজে বিবাদ,বিদ্বেষ, হানাহানি দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মধ্যযুগীয় বর্বরতা এখনও আমাদেরকে গ্রাস করে রেখেছে। বিবেক-বুদ্ধি নির্বাসিত, চিন্তাশক্তি মৃতপ্রায়। তাই কুরবানির মাহাত্ম্য আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে।

প্রসঙ্গ কথাতো অনেক হল, এবার স্মৃতিকথায় আসি। ছোটবেলায় কুরবানির মাহাত্ম্য অনুধাবনের চেয়ে আনন্দই মুখ্য ছিল। বেশ উপভোগ্য ছিল শৈশবের কুরবানির সময়গুলো।বাড়ির বড়দের সাথে হাটে যেতাম কুরবানির গরু কিনতে। সকাল পেরুলেই শুরু হয়ে যেত হাটে যাওয়ার প্রস্তুতি। কয়েকমাইল পায়ে হেঁটে বাজারে যেতে হতো। সারা মাঠজুড়ে নানা রংয়ের ছোট-বড় গরুর সমাহার। মাঠের এক পাশে ছাগল,ভেড়ার সমাহার। আমার সকল আগ্রহ ছিল রং-বেরংয়ের গরুর প্রতি। বড় বড় গরুর শিং ও গলায় মালা পরানো হতো। বড়রা ব্যস্ত গরুর দর-দাম নিয়ে। দর-দামে না হলে পরদিন অন্যবাজারে ছুটে যেতাম।  সাধারণত ২/৩ বাজার যাচাই করে কুরবানির গরু কেনা হতো। তারপর গরুর রশি ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি নিয়ে আসতাম।পথে নানাজনের নানা মন্তব্য বেশ উপভোগ করতাম।বাড়ি ফেরার পর মনের আনন্দে পথের ক্লান্তি ভুলে যেতাম।

ঈদের দিন সকাল সকাল নামাজ শেষে মসজিদের ইমাম সাহেব গরু কুরবানির জন্য প্রথমে আমাদের বাড়িতে আসতেন। গরু জবাই করার পর গোশত বানানো,বিলি-বন্টন, তারপর রান্নার আয়োজন। কে আগে রান্না করে খাওয়াবে তা নিয়ে শুরু হয়ে যেত প্রতিযোগিতা। বাড়ির সবাই পরম তৃপ্তি সহকারে কুরবানির গোশত ভোজনে মেতে উঠতো। এখন সবার সামর্থ্য বেড়েছে, সবাই আলাদা আলাদা কুরবানি দেয়, কিন্তু ছোট বেলার সেই আন্তরিকতা আর খুঁজে পাইনা।

কুরবানি ঈদের আনন্দময় স্মৃতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সিলেটের মীরগঞ্জ  বাজারের কুশিয়ারা নদীর ঘাটে সেই বেঁদে নৌকার স্মৃতি। বাবার চাকুরির সুবাদে আমরা মীরগঞ্জে থাকি। ১৯৮৮সাল,আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। কুরবানির জন্য গরু কেনা হলো।সেবারই প্রথম বাবা আস্ত গরু কুরবানি দিলেন। ঈদের দিন পড়ন্ত দুপুরে বাবা আমাকে বললেন, নদীর ঘাটে যেতে পারবি? আমি কারণ না জেনেই বললাম,পারবো। তিনি আমার হাতে কুরবানির মাংসের একটি প্যকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,নদীর ঘাটে বেঁদেদের একটি নৌকা আছে,মাংসের প্যাকেটটি তাদেরকে দিয়ে আয়। আমি সানন্দে মাংসের ব্যাগ নিয়ে বাজারের শেষপ্রান্তে এসে নদীর ঘাটের দিকে তাকালাম।ঘাটে সত্যিই বেঁদেদের একটি বড় নৌকা বাঁধা আছে।নৌকার কাছে গিয়ে দেখি, নৌকার ভেতরে  নারী-পুরুষ একসাথে বসে হুক্কায় টান দিচ্ছে।আমাকে দেখে কিছুটা বিষ্ময়। আমি মাংসের ব্যাগটি দেখিয়ে বললাম, আমার বাবা পাঠিয়েছেন আপনাদের জন্য।আমি তাঁদের চেহারায় পরিতৃপ্তির হাসি দেখতে পেলাম।সামান্য উপহার, কিন্তু আনন্দ সীমাহীন। আমিও অভিভূত আমার বাবার এহেন মানবিক আচরণে।

লেখক:   সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

                                   কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।