যেখানে বউ ছাড়া বাসা মিলে না!

 

তৈয়বুর রহমান সোহেল।।
সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা। এর প্রতি যদিও যারপরনাই বিরক্ত, তবুও কিছু কথা বলি। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা চোখে রঙিন স্বপ্ন দেখে শহরে আসেন। সবাই নিজের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে চান, কেউ পান কেউ পান না। একপর্যায়ে ভর্তির পর্ব শেষ হয়। পরিবার থেকে টাকা-পয়সা, গ্রামে টিউশন-প্রাইভেট পড়িয়ে জমানো কিছু টাকা নিয়ে পছন্দের মেসে উঠে যান। আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী ছাত্রদের থাকা-খাওয়ায় ভিন্নতা থাকে। অনেক ছাত্র লজিং করেন। বড় ভাইদের ধরে অনেকে টিউশনি জোগাড় করেন। পার্টটাইম চাকরির সন্ধান করেন গুটিকয়েক ছাত্র। যদিও এই কুমিল্লা শহরে খণ্ডকালীন চাকরির দেখা মেলা ভার। তবুও সবাইকে ছুটতে হয়। একসময় বেশিরভাগ ছাত্র থিতু হন। তারপর চলে নতুন লড়াই। এই লড়াই-সংগ্রামে কত মর্মব্যথা লুকানো তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও বোঝার সাধ্য নেই। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শত শত মেয়ে এই কুমিল্লা শহরেই মেসে সেলাইয়ের কাজ করে পয়সা জোগাড় করেন। ছেলেরাও নানামুখী যন্ত্রণা ভোগ করেন। একবেলা আধপেটা খেয়ে আরেক বেলা উপোস থাকার ঘটনা অহরহ। তবু অসীম ব্যক্তিত্ব নিয়ে লক্ষ্যপানে ছুটে চলা শেষ হয় না। একদিন ছাত্রত্ব শেষ হয়। কাঁধে দায়িত্বের বোঝা চাপে। দশ-বিশ টাকা বাঁচিয়ে সিগারেট খাওয়ার দিন ফুরিয়ে আসে। এদিকে চাকরির পরীক্ষায় নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার ছোবলতো আছেই। একসময় বইয়ের পাতায়, শিক্ষকের কথায়, ইতিহাসের মলাটে দেখতে পেতাম, বাংলাদেশের আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কথাটি। লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস পড়ি। একসময় এসব কথারও যেন গুরুত্ব কমে আসে! মাথায় ভর করে বাঁচতে চাই, সুন্দর জীবন চাই। মায়ের জন্য সুন্দর একটা শাড়ি, ভাই-বোনের বায়না মেটানো, বাবার চিকিৎসা খরচ মেটানোর দায়িত্ব, সাথে সমাজের ভ্রু-কুচকানোর বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। কিন্তু অকার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতা সাধ পূরণে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। লেজ ধরে টানাটানির ঘটনাও আছে!
আমি এই শহরের ত্রিশ ছুঁইছুঁই এক ব্যাচেলর। প্রায় এক যুগ ধরে কুমিল্লা শহরে আছি। কারণে-অকারণে কুমিল্লা শহরে ষোলোবার বাসা পরিবর্তন করেছি। কখনও ১৯ দিন, কখনও তিন মাস থাকার পর বাসা-মেস পরিবর্তন করতে হয়েছে। সর্বশেষ যে বাসাটায় আছি, তার আগের বাসাটায় থাকতে পেরেছি ২৪ ঘণ্টা! দীর্ঘ এক যুগ পর ইচ্ছা হলো মেস ছেড়ে নিজে বাসা নিই। বোনটা এখানে থেকে মাস্টার্স করুক। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ভাগ্নে প্রস্তুতি নিতে থাকুক। মাঝে মধ্যে কুমিল্লায় এনে বাবা-মায়ের চিকিৎসা করাবো, এ ছিল বাসা নেওয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রথম দিন রাতে যে ঘটনা ঘটলো তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! এই শহরে এমন নোংরা মানসিকতার মানুষও আছে, ভেবে গৌরবের মাথায় আরেক দফা পানি ঢেলে দিতে হয়। দিনে গোছগাছ কিছুটা হলো। বোন আসবে পরদিন। ভাগিনা-ভাতিজা-আমিসহ তিনজন বাসায়। এসময় হুড়মুড় করে হাজির বাড়ির দারোয়ান ও এক ভাড়াটিয়া। দারোয়ান রুদ্রমূর্তি। ভাড়াটিয়া উত্তেজিত। আপনারা কেন এখানে আসলেন? ব্যাচেলরদের এ বাসার সীমানাতেও প্রবেশ নিষেধ ইত্যাদি বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো। সাথে বলতে লাগলো আপনার বউ কোথায়? আপনারা এখানে থাকলে আমরা সকল ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে চলে যাবো! ভদ্রতার সাথেই বললাম, বোন, মা, বাবা কি পরিবারের বাইরে? ভদ্রলোকরা কোনও কথা শুনবেন না। তাদের একটাই কথা এটাকে পরিবার বলে না। রাতে না পারলে সকালের মধ্যে চলে যেতে হবে। কথা বাড়াইনি। এদিকে সকালের মধ্যে বাসা ছাড়ার তাগিদ। টু-লেট পেজে বিজ্ঞাপন দেখে খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। ভোরে নতুন বাসার সন্ধান মিললো। সাথে মিটলো আমার মিষ্টি শহরে বিড়ম্বনার সাধ।
দুঃখ-বেদনা জীবন সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে। কষ্টের পর যে প্রাপ্তি তার প্রশান্তি আলাদা। আগের চেয়ে ভালো আছি। মনে হচ্ছে কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষের সংস্পর্শ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। তবু এমন একটি ঘটনা হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিবে। জানিয়ে দিবে শহরগুলোয় ব্যাচেলররা কেমন আছে!

লেখক: কুমিল্লা প্রতিনিধি, দ্য ডেইলি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও বাংলা নিউজ।