গাজায় ‘গণহত্যার’ আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি

: শান্তির প্রতিশ্রুতি, না এক নতুন অশান্তির ছায়া?
– মনোয়ার হোসেন রতন||
গাজার আকাশে যুদ্ধবিমান আর নেই, মাটিতে ট্যাংকের গর্জন থেমে গেছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমশ বিলীন হচ্ছে বাতাসে। সংবাদমাধ্যমে খবর আসে—“গাজায় গণহত্যা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে”। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে মানবতা, তারপর প্রশ্ন তোলে—এই ‘শেষ’ কি কেবল ঘোষণায় সীমাবদ্ধ? নাকি সত্যিই থেমে গেছে রক্তের ধারা?
যে ভূখণ্ডে মৃত্যু ছিল প্রতিদিনের অতিথি, যেখানে শিশুরাও লাশ গোনে খেলনার বদলে, সেখানে ‘শান্তি’র ঘোষণায় মানুষের বিশ্বাস কাঁপে। বাস্তবতা হলো, এই ঘোষণার নেপথ্যে রাজনৈতিক কৌশল, কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক চেহারাবদলের চেষ্টা থাকতে পারে—কিন্তু মাটির নিচে শুয়ে থাকা হাজারো মানুষের আত্মা কি শান্তি পেয়েছে?
বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে নিহত হয়েছে প্রায় ৬০,০০০–৬৭,০০০ মানুষ, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, যুদ্ধের কারণে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে, অনেকেই স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত—শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি সরবরাহ লাইন—সব যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
শিশুদের মধ্যে প্রচণ্ড পুষ্টিহীনতা, রোগ ও মানসিক আঘাত এখন এক নিদারুণ বাস্তবতা। ইউনিসেফের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ৫০,০০০ এরও বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার এবং অনেকেই চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর মুখে। গাজার জনগণের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপত্তা এখনো স্বপ্নের মতো।
এই প্রেক্ষাপটে যখন ঘোষণা আসে, ‘গণহত্যা শেষ হয়েছে’—তখন সেটি যেন প্রশ্ন জাগায়, শান্তি সত্যিই এসেছে, না এটা আরেকটি কূটনৈতিক মুখোশ? কারণ, যুদ্ধ বন্ধ করা মানেই শান্তি নয়; শান্তি তখনই আসে, যখন ন্যায়বিচার হয়, অধিকার নিশ্চিত হয়, এবং ভয়হীনভাবে বাঁচার সুযোগ তৈরি হয়।
এখানেই উঠে আসে আরেকটি বিতর্ক—যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা এবং তার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে সম্পাদিত “আব্রাহাম চুক্তি”—যার মাধ্যমে ইসরায়েল ও কিছু আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়—তাকে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক অভাবনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে অনেকের দৃষ্টিতে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই চুক্তি কি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অথবা ফিরে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেছে? নাকি এটি কেবল একটি কৌশলগত চুক্তি ছিল, যার লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠন এবং ইসরায়েলের অবস্থান শক্ত করা?
যদি ট্রাম্প শান্তিতে নোবেল পুরস্কার না পান, তাহলে কি এই অঞ্চল পুনরায় অশান্ত হয়ে উঠবে? এটি নিছক পুরস্কারের প্রশ্ন নয়—বরং এর পেছনে আছে বৈশ্বিক কূটনীতির মেরুকরণ। অনেকে মনে করেন, এই পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে ট্রাম্প তার মধ্যপ্রাচ্যনীতি বৈধতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, শান্তির চেয়ে অনেক বেশি বিভাজন তৈরি হয়েছে তার পদক্ষেপে।
শান্তি কোনও একক নেতার কৃতিত্বে আসে না—শান্তি আসে পারস্পরিক সম্মান, সমঝোতা ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে। নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায় যদি কোনও শান্তিচুক্তি ভেঙে পড়ে, তবে সেটি প্রকৃত শান্তি নয়, বরং একটি প্রহসনের চুক্তি ছিল।
গাজায় গণহত্যার “সমাপ্তি” যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তবে সেটি হতে হবে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির শুরু। সেখানে প্রয়োজন—
- অবরোধ প্রত্যাহার,
- আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে যুদ্ধাপরাধ তদন্ত,
- পূর্ণ পুনর্বাসন ও চিকিৎসা সহায়তা,
- এবং গাজার মানুষদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনে ফেরার অধিকার।
একটি শিশুর মুখে হাসি ফোটার চেয়ে বড় শান্তির প্রমাণ আর কিছু হতে পারে না। যখন একজন মা নিশ্চিন্তে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারবেন, যখন একজন শিক্ষক আবার পাঠদান শুরু করতে পারবেন ভাঙা শ্রেণিকক্ষে—তখনই বলা যাবে, শান্তি এসেছে। ঘোষণায় নয়, মানুষের জীবনে শান্তি স্পষ্ট হলে তবেই তা স্থায়ী হয়।
“রক্তমাখা মেঠো পথ ঘুরে ফিরেছে কারো পায়ের হাঁটা, কাঁপে আকাশ, কাঁপে জমিন—শুধু বেদনা শোনা যায়।”
শান্তি যেন কবিতার এই করুণারেখা না হয়, বরং হয়ে ওঠে এক নতুন সকাল—যেখানে বাতাসে শিশুদের কণ্ঠে গান শোনা যায়, আর ধুলোয় ঢাকা শহরে ফেরে বেঁচে থাকার আলো।
সত্যিকারের শান্তি গঠনের পথে বিশ্ব নেতৃত্বের উচিত ঘোষণা নয়, বাস্তব পদক্ষেপে এগিয়ে আসা। ট্রাম্প হোন বা অন্য কেউ—নোবেল পুরস্কার না পেলেও তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, তারা মানুষের পাশে, নির্যাতিতদের পাশে, ইতিহাসের সঠিক পাশে রয়েছেন।
কারণ, ঘোষণায় নয়—শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়, মানবতা ও দায়িত্বের মাটিতে দাঁড়িয়ে।
