গুণাইঘরে দেড় হাজার আগে যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান!
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,মুরাদনগর।।
বর্তমান কুমিল্লা জেলা প্রাচীন সমতট রাজ্যের অংশ ছিল। এ ভূখন্ডের বিভিন্ন স্থানে প্রস্তর যুগেও মানুষের বসতি ছিল বলে জানা যায়। ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে কুমিল্লা অঞ্চল গুপ্ত সম্্রাটদের বসতি ছিল । খ্রীস্টিয় ৫ম শতাব্দীর শেষে এবং ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শুরুতে এ প্রদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন ছিল। গুণাইঘরের প্রাচীন নাম গুণিকাগ্রহার। অত্যন্ত প্রাচীন এক জনপদ। কুমিল্লা শহর থেকে দেবিদ্বার উপজেলা সদরের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। এটি শহর থেকে উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। মহারাজ বৈন্যগুপ্তের গুনাইঘর তাম্্রশাসন ( ৫০৭-০৮ ) খৃ: থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে দুটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। বিহার দুটির নাম ছিল আশ্রম বিহার ও রাজ বিহার। এই তা¤্রশাসনে আচার্য শান্তিদেব ও জিওনসেন নামক দুইজন বৌদ্ধ আচার্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আাশ্রম বিহারের অবস্থান সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় এটি রাজ বিহার নামক আরেকটি বিহারের পাশে অবস্থিত ছিল। ঐ বিহারের পাশে কামদেবের একটি হিন্দু মন্দিরও ছিল। এতে ঐসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র ফুটে উঠে। পন্ডিতেরা মনে করেন এই প্রাচীন ৩টি ইমারতই গুণাইঘরের সৌন্দর্য বর্ধন করতো। প্রাচীন উত্তর মন্ডল নামটি বর্তমান গঙ্গামন্ডলের সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে গুণাইঘর গ্রামে প্রাপ্ত তা¤্রশাসন থেকে এর প্রমাণ মেলে। তা¤্র শাসন থেকে জানা যায়, বৈষ্ণ ধর্মাবলম্বী মহারাজ শ্রী বৈন্যগুপ্ত তার সামন্ত মহারাজা বিজয় সেনের মাধ্যমে ” অবলোকিত” নামে উৎসর্গীকৃত ” আশ্রম বিহার ” ও ” রাজ বিহার ” ।( সূত্র -রাজমালা ) ।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায় গুণাইঘরে শ্রীবন্যগুপ্তের তা¤্রশাসনটি গুপ্ত বংশের মহারাজা শ্রীবন্যৈগুপ্তের শাসনামলের। তা¤্র শাসনের মূল বক্তব্য ছিল এরকম: আপনাদিগের অবগতি হউক যে, ” আমার পিতামাতার এবং নিজের পূণ্যবৃদ্ধির জন্য আমাদের চরণের দাস মহারাজ রুদ্রদত্তের বিজ্ঞাপনক্রমে উক্ত ( রুদ্রদত্ত ) কর্তৃক মহাযান মতাবলম্বী বৌদ্ধ ভিক্ষু অঅচার্য শান্তিদেবের উদ্দেমে ৯ দিকে ) আর্য অবলোকিতশ^রের নামে যে আশ্রম বিথর নির্মিত হইতেছে , সেখানে উক্ত আচার্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মহাযানীর ” বৈবতিক” সংজ্ঞক ভিক্ষুসংঘের আবাসগৃহে স্থাপিত ) ভগবান বুদ্ধের গন্ধ – পুষ্প –ধূপ -দীপাদি দ্বারা সর্বদা প্রত্যহ তিন বেলা ( পূজা প্যবর্তনের জন্য ) ভিক্ষুসংঘের বস্ত্র, আহার, শয্যা, আসন, পীড়িতের ওষুধ ।প্রভৃতি ভোগের ব্যবস্থার জন্য এবং বিহারের ভাঙ্গা কিংবা ফাটার সংস্কার সাধনের জন্য উত্তর মন্ডলে অবস্থিত কান্তেদক নামক গ্রামে পাঁচ খন্ডে বিভক্ত ১১ পাটক পরিমিত খিলভ’মি সর্বপ্রকার ভোগ সত্তে অগ্রহার রুপে তা¤্রশাসন দ্বারা মং কর্তৃক প্রদত্ত হইল। দানকৃত ভুমির পরিমাণও জানা যায় । দানকৃত ভূমির প্রথম কন্ডের পরিমাণ সাত পটক নয় দেগ্রাণবাপ ও সীমাচিহ্ন পূর্বদিকে গুণিকাগ্রহার নামক গ্রামের সীমানা ও বিষ্ঞু নামক বর্ধকির ( সূত্রধরের) ক্ষেত্র দক্ষিণে সিদ্ধবিল্লাল ( ? ) ক্ষেত্র ও রাজবিহারের ক্ষেত্র ।”তা¤্রশাসনে ভ’মিদানের কথা বলা হয়েছে। সময় উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮৮ গুপ্তাব্দ ।
তা¤্রশাসনটিতে দুজন সামন্ত রাজার নাম রয়েছে। এদের একজন বিজয়সেন এবং অন্যজন রুদ্রদত্ত। গুপ্তযুগীয় ভাষ্কর্য শিল্পধারার অব্যবহিত পরবর্তীকালের ( আনুমানিক ) সপ্তম শতাব্দীতে বলে প্রতœতত্ববিদেরা মনে করেন। গুপ্তদের ক্লাসিক্যাল শিল্প প্রভাব দেখে মনে হয় এখানকার শিল্পীরা গুপ্ত যুগের শিল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও এ থেকে এটাও পরিষ্কার যে কুমিল্লা অঞ্চলে এককালে গুপ্তদের স্বর্ণযুগীয় শ্সকদের শাসন ছিল। তৎকালীন সমতটে গুপ্তদের শাসনের আরো কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালে গুপ্ত যুগের আরো একটি তাম্প্রলিপি পাওয়া যায় নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার থানাই দহগ্রামে। তা¤্রলিপিটি গুপ্তস¤্রাট প্রথম কুমার গুপ্তের ( ৪১৫-৪৫৫) আমলের। ১১৩ গুপ্ত সংবৎসরে অর্থাৎ ( ৪৩২-৪৩৩) খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তা উৎকীর্ণ। সূত্র কুমিল্লার ইতিহাস- আদি পর্ব – আবুল কাশেম, গতিধারা পাবলিকেশন ২০০৮, ঢাকা।
তা¤্রশাসনে উল্লেখ আছে মহারাজা বৈন্যগুপ্তের সামন্ত মহারাজা বিজয়সেনের মধ্যে অবলেকিতেশ^র নামে উৎসর্গীকৃত ” আশ্রম বিহারের” জন্য ” উত্তর মন্ডলে ” ১১ পাটক ভূমি দান করেছিলেন। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর লিপিতে ভূমিদানপত্রে ” ভূক্তির ” উল্লেখ রয়েছে। ” ভূক্তি ” মানে বিভাগ। পত্যেক ভূক্তি কতগুলো বিষয়ে , বিষয় কতগুলো মন্ডলে মন্ডল কতগুলো বিথিতে এবং বিথিতে এবং বিথি কতগুলো গ্রামে বিভক্ত ছিল। দেবিদ্বারে বিহারমন্ডল নামে একটি স্থান রয়েছে। ” ভূক্তির” শাসনকর্তাকে গুপ্ত স¤্রাট নিজেই নিয়োগ করতেন বলে মনে হয়। তাকে বলা হতো উপরিক মহারাজা। কুমার অমাত্ত , আযুক্তক, বিষয়পতি, প্রভৃতি রাজ কর্মচারীদের নাম পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণণের ধারণা ফুটে উঠে। বৈন্যগুপ্তের সামন্ত নরপতি বিজয়সেনের পদবী ছিল মহারাজা। তাকে আবার বলা হয়েছে দূতক, মহাপতিহার, মহাপিলুপতি, পঞ্চাধিকরণ ( পৌরিক এবং পাটু ) পৌরিক । এ পাঁচটি পদের তত্বাবধায়ক ছিলেন পঞ্চাধিকারক। এগুলোর মধ্যে ছিল রাজদূত, শান্তিরক্ষক, হস্তিসৈন্যের অধ্যক্ষ। প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান হিসাবে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শশনগুলো থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত যে গুণাইঘরে নির্মিত বৌদ্ধ বিহার ও কামদেবের মন্দির বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিহার ও হিন্দু মন্দির। এ গ্রামে অসংখ্য মূর্তি পাওয়া গেছে। এ সম্পর্কে শ্রী দিনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, এই গ্রামেই কষ্টি পাথরের একটি বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া যায়। এছাড়া একটি দ্বাদশ হস্ত অবলোকিতেশ^র মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে । তার পাদপীঠে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধমন্ড (” সে ধর্মা” ) ইত্যাদি উৎকীর্ণ রয়েছে। সুতরাং প্রত্নসম্পদে এ গ্রাম ত্রিপুরা জেলায় শীর্ষ স্থান দখল করবে।”
লেখক : মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলেজ শিক্ষক।