শতবর্ষের প্রহরে জন্ম যার

মনোয়ার হোসেন রতন।।

রাতের অন্ধকারে শহরের আকাশ ছিঁড়ে যাচ্ছিল বুলেটের শব্দে। দূরের মিছিল থেকে ভেসে আসছিল গর্জন—“স্বাধীনতা না হলে মৃত্যু!” ধুলো উড়ে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, লণ্ঠনের আলোর ঘরে এক নিঃশব্দ যুদ্ধ চলছিল—জীবন আর মৃত্যুর লড়াই। ১৯৬৮ সালের ২২ ডিসেম্বর, শীতল রাতে আমার প্রথম কান্না ভেসে মিশেছিল গুলির প্রতিধ্বনি আর শ্লোগানের স্রোতে। কিন্তু সেই কান্নার প্রতিধ্বনি মায়ের কোল কাঁপিয়েছিল—এর কিছুকাল পর মা চলে গেলেন চির অজানায়। মাতৃত্বের উষ্ণতা ছাড়াই শুরু হলো আমার জীবনের দীর্ঘ সংগ্রাম—এক নিঃসঙ্গ শৈশবের যাত্রা।

ঠিক এক শতাব্দী আগে, ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ—রাশিয়ার বরফ-ঢাকা এক নিঃস্ব জনপদে জন্ম নিয়েছিলেন আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর অবিচারের শৃঙ্খলে জন্ম নেওয়া এ মানুষটি নিজের নাম বদলে রাখলেন,“ম্যাক্সিম গোর্কি”জীবনের প্রতি তিক্ত বিরক্ত হয়ে এ নাম ধারণ করলেন। এ নামেই তিনি বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে বিপ্লবের মশাল জ্বালিয়েছিলেন। তাঁর কলম নিছক সাহিত্য ছিল না—এটি ছিল নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অস্ত্র। “মা”, “দ্য লোয়ার ডেপথস”, “দ্য আর্টামনভ বিজনেস”—প্রতিটি সৃষ্টি শোষণবিরোধী প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠেছিল।

আমার জন্মের সময় বাংলার প্রান্তরেও সেই একই অগ্নি জ্বলছিল। দখলদার শাসন, সামরিক নিপীড়ন, মুক্তির আন্দোলন—প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি মাঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মুক্তির ডাক। আমার জন্ম যেন এই আন্দোলনের সাথে অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছিল। পরিবারের কান্না, জনপদের শোক, আন্দোলনের তীব্রতা—সব মিলিয়ে আমার জন্মের কান্না ইতিহাসের আর্তনাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।

তখন আমার দেশের মানুষের শৈশব কেটেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর স্বৈরশাসনের অন্ধকারে। তবে প্রতিবাদের ধ্বনি থামেনি। আশির দশকের বাংলাদেশে প্রতিটি মিছিল, নাট্যমঞ্চ, দেয়াললিখন গোর্কির বিদ্রোহী সাহিত্যকে নতুন জীবন দিত। তাঁর “মা” আমাদের পাড়া মহল্লার প্রতিবাদী নারীদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল—যাঁরা সন্তানের হাতে তুলে দিতেন লাল পতাকা, লিখতেন “বঞ্চিতদের হাত শক্ত করো!”

কিন্তু ইতিহাসের চাকা থেমে থাকেনি। রুশ বিপ্লবের পতন, বার্লিন প্রাচীরের ভাঙন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নভঙ্গ আর পুঁজিবাদের অমানবিক উত্থান বিশ্বকে গ্রাস করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলেও গণতন্ত্র কফিনে বন্দি রয়ে গেল। গুম, খুন, বিচারহীনতা আর দুর্নীতি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে নাচতে থাকে।

এ বাস্তবতা আমাকে কলম হাতে তুলতে বাধ্য করেছে। আমি বিশ্বাস করি—“সাহিত্য যদি সত্য না বলে, তবে তা মৃত কল্পনা মাত্র।” আমার লেখায় উঠে আসে সেই মধ্যবিত্তের ক্ষুধা, যার হাতে ভোট আছে কিন্তু রুটি নেই; সেই কৃষকের আহাজারি, যিনি সোনা ফলিয়ে সন্তানের জন্য দুধ কিনতে পারেন না; সেই শ্রমিকের চিৎকার, যে ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেও বস্তির অন্ধকারে জীবন কাটায়। আমার কলম রাজনীতির শকুনদের মুখোশ উন্মোচন করে, যারা উন্নয়নের নামে জাতির বুকের রক্ত শুষে নেয়।

২০২৪ সালের বর্ষায় দেখেছি নতুন ইতিহাসের জন্ম—ছাত্র, তরুণ, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী মিলে এক রক্তঝরা বিপ্লব। সেই বিপ্লব শিখিয়েছে—স্বপ্ন দেখতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতেও জানতে হয়। জানিয়ে দিয়েছে—একবার যে আগুন জ্বলে, তা কখনও নিভে না। সেই আগুনই ছিল গোর্কির কলমে, সেই আগুনই আজও জ্বলছে আমার লেখায়।

গোর্কি বলেছিলেন—“মানুষকে বোঝো, মানুষকে ভালোবাসো, মানুষকে জাগাও।” আমি তাই করি। আমার সাহিত্য নিছক ফুলদানি নয়—এটি ইতিহাসের নর্দমা উন্মোচন করে, ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে হাসতে শেখায় বিজয়ের হাসি। শতাব্দীর শোষণ ভাঙার ভাষা দেয়। রাষ্ট্রের মঞ্চে মুখোশধারী নেতাদের নাটকের বিপরীতে আমি সত্যের কাহিনি লিখি।

আমার জন্ম ও গোর্কির জন্ম—দুই শতাব্দী, দুই মহাদেশ হলেও আমাদের চেতনার ধারা একই। আমরা দুজনেই কলম হাতে নিয়েছি বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন—“সাহিত্য হতে হবে সত্যনিষ্ঠ।” আমি তাই দৃপ্ত কণ্ঠে বলি—“কলম হোক আগুন, শব্দ হোক বিপ্লব।”

এ লেখা কেবল আত্মজীবনী নয়—এটি শতবর্ষী প্রতিরোধের উত্তরাধিকার। আমি চাই, ভবিষ্যতের কেউ একদিন বলতে পারে—“সে গোর্কির উত্তরাধিকার বুকে নিয়ে জন্মেছিল, আর কলমে আগুন জ্বালিয়েছিল—শোষণের ঘুণপোকা পোড়াতে।”

এ হোক আমাদের সাহিত্যিক বিপ্লবের অঙ্গীকার—যা বিশ্ব ইতিহাসের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিক স্বাধীনতার আলো, ন্যায়ের শপথ, এবং অমানবিক শাসনের বিরুদ্ধে এক অগ্নিজাগরণ।

inside post
আরো পড়ুন