গ্রাম আলোকিত করা সেই শিক্ষকের বাড়ি ফেরা

অফিস রিপোর্টার।।
সুনীতি রাণী বিশ্বাস। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নোয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ১৫ বছর আগে এই স্কুলে আসেন। তখন স্কুল ছিলো ভাঙাচুরা। গ্রামে বিদ্যুত ছিলো না। সড়ক গুলো যেন ধান ক্ষেত। শিক্ষকরা এই স্কুলে বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। স্কুলে ছাত্র কম ছিলো, তাদের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে আনতে হতো। সেই এলাকা এখন বদলে গেছে। পিচঢালা সড়ক হয়েছে। হয়েছে স্কুলের বহুতল ভবন। গ্রামে বিদ্যুতের আলো জ¦লছে। স্কুলে শিক্ষার্থী বেড়েছে। স্থানীয় শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশ করায় এখন বদলি কমেছে। বি- ক্যাটাগরির স্কুল এখন এ- ক্যাটাগরি হয়েছে। সুনীতি রাণী বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত হয়েছে নোয়াপাড়া গ্রাম। তাকে নিয়ে গত বছর বাংলাদেশ প্রতিদিন ও আমোদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করেছিলো। সেই শিক্ষক ৩৭বছর কর্মজীবন শেষে বুধবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
তাঁর বিদায় উপলক্ষে কর্মস্থল কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নোয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রিয় শিক্ষককে বিদায় জানাতে সকাল থেকেই জড়ো হন বর্তমান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। ফূল ও উপহার হাতে হাজির হন বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি অমৃত দাশের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বরুড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. তরিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার মো. সোলেমান ভূঁঞা, মো. মিজানুর রহমান মজুমদার, আব্দুল কুদ্দুস প্রধান, মো. তোফাজ্জল হোসেন, প্রাক্তন পিটিআই ইন্সট্রাক্টর উত্তম দাশ গুপ্ত, কেন্দ্রীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা শাহাদাত হোসেন ভুঞা, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা আব্দুল হক,ডাবুরিয়ার সমাজ সেবক আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন নোয়াপাড়া সরকারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মোতাছাম বিল্যাহ এবং বিদায় মানপত্র পাঠ করেন প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক ঝর্ণা রানী দাশ। ধন্যবাদ জানান অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব প্রাক্তন শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক। পেরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুভেন্দু শেখর দাস পিন্টু এবং লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম হাজারীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে এলইডির পর্দার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সুনীতি রাণী বিশ্বাসের কর্মজীবন।


স্কুলের সূত্র জানায়, সুনীতি রাণী বিশ্বাস ১৯৬৫ সালে বরুড়া উপজেলার দোঘই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শীতল চন্দ্র বিশ্বাস ও মা কামিনী সুন্দরী বিশ্বাস। শৈশবে ১৯৭০ সালে বাবাকে হারিয়েছেন। তাই একরকম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৮৬ সালে যোগ দেন বরুড়ার খাজুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপরে কাজ করেন একই উপজেলার লক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন চিতোষী রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৮২ সালে বাঁধা পড়েন সাতপাকে। স্বামী একই উপজেলার দৌলতপুরের নিখিল দেওয়ানজী। তিনিও হাইস্কুল শিক্ষক ছিলেন। ২০০০ সালে পরলোকগমন করেন।
সুনীতি রাণী বিশ্বাস জানান, স্বামীর আকস্মিক চলে যাওয়ায় কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন। তখন তিন সন্তান ছোট। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের চাকরির সুবাদে যে বেতন পেতেন, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার খরচ চলতো। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বুঝতে দেননি বাবার অভাব। তিনি চেয়েছিলেন স্বামী ও নিজের মতো সন্তানদেরও শিক্ষক বানাবেন। তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তিন সন্তানই এখন শিক্ষক।
স্কুলের বিষয়ে বলেন,বিদ্যুতের জন্য পাশের চান্দিনা উপজেলার পল্লী বিদ্যুত সমিতিতে গিয়ে দরখাস্ত দিয়েছি। তারপর এলাকায় বিদ্যুত এসেছে। এভাবে ছাত্র জোগাড়, স্কুল ভবন করা ও সড়কের বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করতে হয়েছে। আমাদের উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা,জনপ্রতিনিধি ও স্কুল কমিটির সবার সহযেগিতা কাজ গুলো করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ৩৭বছর কর্মজীবন শেষে অবসরে গেছেন। অবসরে কথা মনে হলে তার চোখ জলে ভেসে যায়। সকালে আর স্কুলে আসার তাড়া থাকবে না। কেউ তার নিকট ছুটির দরখাস্ত নিয়ে আসবে না।
শিক্ষক জীবনের আনন্দের স্মৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, তার হাজারো শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা সমাজ আলোকিত করছে। পথে দেখা হলে তারা পা ছুঁয়ে সালাম করেন।