‘তিনি থাকবেন গ্রাম বাংলার ফসলের মৌ মৌ গন্ধে’
প্রতিনিধি ।।
দেশবরেণ্য গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সকল স্তরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ফেসবুকে শোকগাথা প্রকাশ করছেন নেটিজেনরা। পাশাপাশি শক্তিমান এই সাধক পুরুষের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল হাসনাত বাবুল বলেন, কুমিল্লার সন্তান গাজী মাজহারুল আনোয়ার বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার সাথে আমার বহু স্মৃতি। তার শ্বশুর ছিলেন কুমিল্লার দীপিকা সিনেমা হলের স্বত্বাধিকারী। সেখানে ১৯৭২ সালে তার আর জোহরা কাজীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। ওই সময় রাজ্জাকসহ ১০০-১৫০ ফিল্ম স্টার বরযাত্রী হয়ে আসেন। ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পরও তিনি কুমিল্লায় নিয়মিত আসতেন। তিনি ২১শে পদক পাওয়ার পর কুমিল্লা ক্লাবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সৎ, ধার্মিক ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে আমরা কুমিল্লাবাসী গভীর শোকাহত।
কুমিল্লার বাসিন্দা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক ম্যানেজার বদরুল হুদা জেনু বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য। মেডিক্যালে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এর আগেই সংগীতাঙ্গনে দাপট দেখাতে শুরু করেন মাজহার। সর্বকালের সেরা ১০টি বাংলা গানের মধ্যে কালজয়ী এই গুণী সাধক পুরুষের লেখা গান তিনটি। অথচ এই মহান মানুষটি আজ যতটুকু মূল্যায়ন পাওয়ার কথা তার সিকিভাগও পাননি। আমি মনে করি, তিন রাজনৈতিক দ্বিচারিতার শিকার হয়েছেন। এটাকে রাজনৈতিক ব্যভিচারিতাও বলতে পারি। গুণীর মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল গুণের বিচারে, রাজনৈতিক বিচারে নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শক্তি যুগিয়েছে যার গান, যার লেখা গান সবার মুখে মুখে তাকে আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারলাম না! নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে।
কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক আহসানুল কবির বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বাবা কুমিল্লা শর্মা কেমিকেলের একজন সম্মানিত পরিচালক ছিলেন। তাদের নিজস্ব ঔষধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছিল। ঠাকুরপাড়া বেঙ্গল ড্রাগসের সাথে তাদের পরিবারের সম্পৃক্ততা ছিল। অধুনালুপ্ত দীপিকা সিনেমা হল, এখন যেখানে রূপায়ণ শপিং মল নির্মাণ করছে। এখানেই ছিল তার শ্বশুর মরহুম বেলায়েত হোসেনের নিবাস। জোহরা গাজী এই বাড়িতেই বড় হয়েছেন। তাৎক্ষণিক লেখার অসাধারণ ক্ষমতা তার। আমেরিকায় এক আড্ডায় বসে বাংলাদেশটা কেমন এই প্রশ্নের উত্তরে দশ মিনিটের মধ্যে লিখেছিলেন, “যদি আমাকে জানতে সাধ হয়, এ মাটির শ্যামলীমায় এসো প্রিয়।” কুমিল্লার এই গর্বিত মানুষটিকে আমরা জীবদ্দশায় মূল্যায়ন করতে পারিনি। তবে তিনি ইতিহাসে অমর। মানুষের কণ্ঠে তিনি থাকবেন হাজার বছর। তিনি থাকবেন বাংলার পথে প্রান্তরে আর ছোট্ট সোনার গাঁয়ে, “যেথায় কোকিল ডাকে কুহু, দোয়েল ডাকে মুহু মুহু,নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।” গাজী মাজহারুল আনোয়ার থাকবেন গ্রাম বাংলার ফসলের মৌ মৌ গন্ধে। তিনি লিখেছিলেন,”গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে কি হবে? জীবন খাতার শূন্যপাতা শুধু বেহিসাবি পড়ে রবে।” আমার বিশ্বাস তাঁর জীবন খাতা পরিপূর্ণতায় ভরপুর হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। নিশ্চয় তিনি ক্ষমা পাবেন। কারণ গাজী মাজহার নিজেই তো বলেছেন,”আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার, শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে তিনি আমায় করবেন পার, আমি পাপি তিনি জামিনদার।”
উল্লেখ্য-গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রোববার ভোরে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।