দাদা! দয়া করুন, ক্ষমতার দুধ ভাত দিন

inside post
মেরুদণ্ডহীনতার জয়গান ও ভারত নির্ভর রাজনীতির নির্মম ট্রাজেডি
মনোয়ার হোসেন রতন।।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার করে এসে আজও যদি কোনো জাতির কণ্ঠে শোনা যায়, “দাদা! দয়া করুন, ক্ষমতার দুধ ভাত দিন”—তবে বুঝে নিতে হবে, সেই জাতি কেবল রাজনৈতিকভাবে নয়, নৈতিক ও কূটনৈতিকভাবেও এখনো পূর্ণতালাভ করেনি। একদিকে ভারতের প্রতি নির্লজ্জ চাটুকারিতা, অন্যদিকে দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা যেন আমাদের এক শ্রেণির রাজনীতিকদের রাজনৈতিক আইডেন্টিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে, একটি মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু আজ, ২০২৫ সালে এসে দেখতে পাই, কিছু ‘নেতা নামধারী ভাড়াটে কবুতর’ দিল্লির আশীর্বাদ পাওয়ার আশায় দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে এতটুকু দ্বিধা করে না। তারা গালি দেয় দিল্লির ভাষায়, আবার ভালোবাসে দিল্লির আশায়। দেশের মানুষকে দিয়ে যায় আশ্বাস, আর নিজের জন্য রেখে দেয় সুবিধা।
ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, শ্রদ্ধাপূর্ণ সহাবস্থান চাই—কিন্তু বন্ধুত্বের নামে আত্মসমর্পণ? দিল্লির নির্দেশে নতজানু রাজনীতি? তিস্তার পানি যেখানে ঠেকিয়ে রাখা হয়, সীমান্তে যেখানে নিয়মিত বাংলাদেশিদের রক্ত ঝরে, সেখানে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী কেবল প্রটোকলের আলোকচিত্রে হাসিমুখ দেখাতে ব্যস্ত। অথচ জনগণের হৃদয়ে জমা হতে থাকে একটার পর একটা ক্ষোভ আর অপমানের ইতিহাস।
ইন্দিরা-মুজিব সীমান্ত চুক্তি (১৯৭৪) আজও পূর্ণ বাস্তবায়ন পায়নি, ফারাক্কা বাঁধ আজও পদ্মার বুক শুকিয়ে দেয়, তিস্তা চুক্তি এখনও কল্পনার গল্প। প্রতিবারই দিল্লি সফরে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারা ‘ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে ফেরেন। কিন্তু বাংলার জনগণ ফিরে পান না কিছুই—না পানি, না সমতা, না মর্যাদা।
২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত সরকারের উত্থান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে ভারতীয় প্রভাব—সবই আমাদের রাজনীতির করুণ এক অধ্যায়। তখন থেকেই এটা স্পষ্ট—দেশের শাসনভার অনেকাংশেই দাদার আশীর্বাদের ওপর নির্ভরশীল। অথচ জাতির মৌলিক চাহিদা, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থের প্রশ্নে সেই দাদা থাকেন নিরব, কিংবা পাশে নয়—উল্টো পাশে।
আজ তাই প্রশ্ন উঠে—এই দেশ কি সত্যিই স্বাধীন? নাকি কেবল স্বাধীনতার সনদ বহন করে?
এখনো আমরা দেখি—দেশের জন্য কাঁদে না কেউ, কাঁদে কেবল ক্ষমতার জন্য। এখনো কিছু নেতা দেশের ভবিষ্যৎ নয়, দিল্লির দরবারে নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে মরিয়া। তারা ইতিহাসকে করে তোলে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা, আর বর্তমানকে ঢেকে রাখে চাটুকারিতার চাদরে।
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ভাবতে হবে—ভারতবন্দনা নয়, চাই বাংলাদেশ-অভিমুখী নীতি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হতে হবে আত্মমর্যাদাপূর্ণ, সাহসী ও ভারসাম্যপূর্ণ। কারণ, ইতিহাস একদিন প্রশ্ন করবে—কারা ক্ষমতার জন্য দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে?
শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে শুধু একটাই সংলাপ উচ্চারিত হতে পারে:
“জয় হোক মেরুদণ্ডহীনতার!”
…এটাই কি হবে আমাদের পরিচয়? নাকি এ জাতি একদিন ঘুরে দাঁড়াবে এবং বলবে—“দাদা নয়, আমার দেশের মানুষই আমার ক্ষমতার উৎস!”
আরো পড়ুন