দিল্লির পায়ে স্বাধীনতা বিসর্জন

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও উপমহাদেশীয় আধিপত্যের বিশ্লেষণ
মনোয়ার হোসেন রতন ।।
স্বাধীনতা শব্দটি কেবল একটি পতাকা উত্তোলন বা একটি গানের গর্বিত সুরে সীমাবদ্ধ নয়। এটি জাতির স্বকীয়তা, সার্বভৌমতা ও আত্মমর্যাদার চূড়ান্ত প্রকাশ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, উপমহাদেশে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাসের পেছনে বহু অপূর্ণতা ও বিকৃত বাস্তবতা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন এটি হবে একটি মুক্ত ও আত্মনির্ভর রাষ্ট্রের সূচনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো—আমরা স্বাধীন হলেও এককথায় দিল্লির পায়ে অনেকাংশে আমাদের সিদ্ধান্ত ও সার্বভৌমতা বিসর্জন দিয়েছি।
ঐতিহাসিক পটভূমি: বিভাজনের ষড়যন্ত্র ও দিল্লির উত্থান
১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাজন ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সর্বশেষ বিভক্তির রাজনীতি। ধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র গঠনের এই সিদ্ধান্ত মূলত একটিকে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কৌশল ছিল। ভারত স্বাধীন হলেও তার শাসন কাঠামো ও পররাষ্ট্রনীতি ব্রিটিশ প্রশাসনের ছায়াতেই থেকে যায়।
ভারত তার “বিশ্বগুরু” নীতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর এক ধরনের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে—বিশেষ করে যেসব দেশ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দিল্লির কৌশলগত ব্যুৎপত্তির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।
রেফারেন্স:
Jaswant Singh, Jinnah: India-Partition-Independence, Oxford University Press, 2009.
বাংলাদেশের জন্ম ও দিল্লির কৌশলী হাতছানি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করলেও এটি নিছক মানবিক সহায়তা ছিল না। এর পেছনে ছিল ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও পাকিস্তানকে দুর্বল করার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র গঠনের কৌশল।
যুদ্ধের পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একাধিক বক্তব্যে দেখা যায়, তিনি বাংলাদেশকে ‘তৃতীয় রাষ্ট্র’ হিসেবে নয়, বরং ভারতের কৌশলগত আগ্রহে একটি বন্ধন হিসেবে দেখেছেন।
রেফারেন্স:
Sarmila Bose, Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War, Columbia University Press, 2011.
ফারাক্কা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত—একতরফা শাসন ও অনিয়ম
স্বাধীনতার পরপরই দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক আচরণ একতরফা। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, গঙ্গার পানিবণ্টন, তিস্তা চুক্তির অনিশ্চয়তা, সীমান্ত হত্যা, বিএসএফের বর্বরতা—সব মিলিয়ে দিল্লি বাংলাদেশের ওপর এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
ভারতের একতরফা নদী নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের কৃষি, নদীজীবন এবং পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
রেফারেন্স:
Imtiaz Ahmed, State, Society and Displacement in Bangladesh, UPL, 2004.
“International Farakka Committee Reports”, Dhaka, 2021.
দিল্লির আধিপত্যবাদী ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশ
ভারতের “Neighborhood First” নীতি মূলত “India First” এ পরিণত হয়েছে। SAARC-এর কার্যকারিতা কমে গেছে, BIMSTEC-এর নেতৃত্ব ভারতের হাতেই কেন্দ্রীভূত। বাংলাদেশকে ঘিরে দিল্লির লক্ষ্য—একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরি করা।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় অংশ এখনও ভারতের দৃষ্টি ও অনুমোদননির্ভর। প্রায় প্রতিটি সরকার পরিবর্তনের গন্ধেই দিল্লির দূতাবাসগুলো তৎপর হয়, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অপমানজনক।
রেফারেন্স:
C. Raja Mohan, Modi’s World: Expanding India’s Sphere of Influence, HarperCollins India, 2015.
নিরপেক্ষতা না আত্মসমর্পণ—বাংলাদেশ কোন পথে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দীর্ঘদিন ধরে ভারসাম্যহীন ও আপোষমুখী। ভারতের স্বার্থে বন্দরের ব্যবহার, ট্রানজিট সুবিধা, চুক্তিতে একতরফা শর্ত মেনে নেওয়া প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তার কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে দিল্লির ছায়া দীর্ঘ।
এমনকি ভারতীয় মিডিয়া ও চলচ্চিত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে একটি ‘মৃদু উপনিবেশ’ -এ পরিণত করছে। এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যও একটি স্বাধীন জাতির আত্মমর্যাদার প্রতি অবজ্ঞা।
রেফারেন্স:
Mahmudul Haque, Foreign Policy of Bangladesh, Bangladesh Institute of International and Strategic Studies (BIISS), 2020.
মুক্তির পথ কোনটি?
আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু স্বাধীনতার চেতনাকে আত্মস্থ করতে পারিনি। দিল্লির পায়ে বারবার আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতি, ভূ-অর্থনীতি বিসর্জন দিতে হয়েছে।
এটি কেবল দুর্বল নেতৃত্ব বা কূটনৈতিক ভুল নয়, বরং আত্মমর্যাদাহীন জাতির এক নিষ্ক্রিয় আত্মসমর্পণ।
সচেতন নাগরিকদের এখনই জেগে উঠতে হবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে না উঠলে এই স্বাধীনতা কেবল একটি রাজনৈতিক ঢাকঢোলই রয়ে যাবে।
সচেতন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান:
সত্য ইতিহাস জানুন এবং জানান।
জাতীয় স্বার্থে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি দাবি করুন।
দিল্লির আধিপত্যবাদী কৌশলের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তুলুন।
রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জবাবদিহির আওতায় আনুন।
inside post
আরো পড়ুন