নতুন কারিকুলাম-সম্ভাবনার নতুন দ্বার

।। বিজয় চক্রবর্ত্তী।।
যে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা যত উন্নত, সে জাতি ততটাই এগিয়ে থাকবে সর্বক্ষেত্রে। এটা সবারই জানা। জাতি হিসেবে বিভিন্ন মানদন্ডে বিশ্ব দরবারে আমাদের অবস্থান ইতোমধ্যেই জানান দিয়েছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। বিশ্ব আমাদেরকে চিনতে শুরু করেছে নতুন রূপে। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে সব কিছুই।
তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ব্যবস্থায়ও আনা হয়েছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। বিশ্বায়নের যুগে বৈশ্বিক নাগিরক হিসেবে আমাদের প্রজন্মকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কারিকুলামকে সাজাতে হয়েছে নতুন আঙ্গিকে। নতুন কারিকুলাম- নতুন প্রত্যাশা। মুখস্থ নির্ভরতা ও পরীক্ষা নির্ভরতাকে নিরুৎসাহিত করে জোর দেয়া হয়েছে হাতে-কলমে বাস্তবিভিত্তিক শিক্ষার উপর। তবে আপাত দৃষ্টিতে পরীক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারেই তুলে দেয়া কতটা সমীচীন হয়েছে সে প্রশ্ন জনমনে থেকেই যায়। ভবিষ্যত কর্মপন্থা এবং এই কারিকুলামের সাফল্যই দিতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর। আমরাও আছি সেই উত্তরের আশায়।
শিক্ষার নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীর চিন্তার বিকাশ ঘটবে, জানার ইচ্ছা জাগবে এবং শিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর তার জন্য প্রয়োজন কারিকুলামের যথাযথ বাস্তবায়ন।
এপর্যন্ত কোনো কারিকুলামই পুরোপুরি বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। তাই নতুন কারিকুলাম কতটা বাস্তবায়িত হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে শিক্ষকরাই। ইতোমধ্যে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে শ্রেণিকক্ষে। শিক্ষকদের পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। শিক্ষকরা নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে হবে নতুন কারিকুলামের সাথে। প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
২০২৩ সালে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির হাত ধরে যাত্রা শুরু করে নতুন কারিকুলাম। এ বছর সংযুক্ত করা হয় ৮ম ও ৯ম শ্রেণি। আগামী বছর ১০ম শ্রেণিসহ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল ক্লাসেই পুরোদমে চলবে নতুন কারিকুলামের কার্যক্রম। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই এসএসসি ও এইচএসসি নিয়েও চলে আসবে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা।
যদিও নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে, শিক্ষণীয় ও প্রায়োগিক অনেক বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ – ইংরেজি বিষয়ের একটি টপিকের কথা উল্লেখ করতে চাই। নবম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একটি লেসনে Argumentative Essay লেখার বিভিন্ন ধাপসমূহ উদাহরণসহ সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে নিজেই একটি Argumentative Essay লেখতে পারবে। পুরনো কারিকুলামে যেখানে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা Essay মুখস্থ করেই লিখতো। একইভাবে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে রয়েছে ইংরেজি কবিতা লেখার কৌশল এবং ৭ম শ্রেণিতে আলোচনা করা হয়েছে গল্প/Story লেখার কৌশল। এভাবে প্রত্যেক শ্রেণিতেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কৌশল তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য বিষয়েও হাতে-কলমে শিক্ষাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অংক-ইংরেজি ভীতি শিক্ষার্থীদের মন থেকে বিদায় নিয়েছে। গণিতেও দেখেছি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ-মাপ এখন নিজেরাই বের করতে পারছে। বাংলা বিষয়েও মুখস্থ নির্ভরতা কমেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষা এখন সময়ের চাহিদা। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীরা একদিন বিশ্বে চালকের আসনে অবস্থান করবে বলে আশা করা যায়। গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিল্প-সংস্কৃতিতে, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে করা হয়েছে সম্পূর্ণই প্রজেক্ট নির্ভর – যা হাতে-কলমে শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব। আমাদের দেশে কো-কারিকুলাম খুবই অবহেলিত ছিল। ফলে বর্তমান শিক্ষায় শিক্ষিতরা এক ধরনের স্বার্থপর হয়ে বেড়ে উঠছে। নতুন কারিকুলামে কো-কারিকুলামের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়টি খুবই গুরুত্ব পেয়েছে যা একজন ব্যক্তির জীবনে খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
তাই বলা যায়, একজন শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার সকল উপকরণই বিদ্যমান নতুন কারিকুলামে। বিভিন্ন বিষয়ে অসঙ্গতিও হয়তো রয়েছে কিছু। আশা করা যায় সেগুলো সংশোধন হবে। সংশোধন করতে হবে মূল্যায়ন পদ্ধতিও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছুটা সংশোধনী আনলে, আশা করা যায় নতুন কারিকুলাম একদিন তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য , তার জন্য প্রয়োজন সরকার-শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সকলের সমন্বিত প্রয়াস।

লেখক:সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি), ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল ও কলেজ, কুমিল্লা।