নতুন প্রজন্মকে বাঁচতে শেখান, স্বপ্ন দেখতে শেখান; মাসুদা তোফা

আমরা যারা অভিভাবক, শিক্ষক আমাদের অনেক দায়িত্ব যা আমরা ইদানিং পালন করিনা বা করছিনা। আমরা ধরেই নিয়েছি শাসন বারণহীন শুধু বিত্তবৈভব আর আদরে সন্তান সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যাবেই । আসলে কি তাই!
ছোটবেলা থেকে ভালো মানুষ হবার যে মন্ত্র শেখানো উচিত তা আমরা করছি কি? না করছি না।  আমাদের ব্যস্ততা এখন আকাশচুম্বি!
নানা কারণেই আমাদের সময় হয়না, সন্তানের জন্য স্বপ্নের বীজ বুনবার ।
আগেরদিনে আমাদের সাধারণ মা বাবারা দশবারো জন সন্তান নিয়েও
তাদের মানুষ করতে কতো স্বপ্নের জাল বুনতেন আর এখন বড়জোর এক বা দুটো সন্তান। তবুও পারছিনা কেন একটু খবর রাখা জরুরি। এখানে আমাদের দুর্বলতা কোথায় ,সমাজ, সরকারের দুর্বলতাইবা কোথায়, খুজে বের করা প্রয়োজন। আর সেভাবে এগুতে পারলে অসংগতিগুলো দূর করা সম্ভব ।

 

জনাব, মাসুদা তোফা। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।
পালটে গেছে আমাদের ধ্যানধারণা, মুল্যবোধ, পালটে গেছে আমাদের বই, পাঠদান পদ্ধতি। নেই সেই অসাধারণ ছড়া, কবিতা, গল্প, যা পড়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। যা একটি বাচ্চাকে জাগিয়ে দেবে তেমন অনেক কিছুই নেই। যা আছে তা নিঃসন্দেহে আধুনিক উন্নত কিন্তু কতটা জীবনবোধসম্পন্ন সেটা দেখার অবকাশ থেকে গেছে।
জীবনকে ভালো লাগার, ভালোবাসার স্বপ্নবোনা,  জীবনের গল্প শোনানোর সময় হয় না আমাদের।

 

আরও পড়ুন>>>

সিদ্ধান্ত নিলাম আর ছাত্র বাড়াবো না ; মাসুদা বেগম 

 

থাক সেকথা, এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের বোধদয় হওয়া ভীষণ জরুরি। যার যা দায়িত্ব তা পালনে কঠোরভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতেই হবে। আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে জীবনের মানে কি। জীবন কুসুমশয্যা নয়, সংগ্রাম করে, নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে লক্ষে যাবার নামই জীবন। আত্মহত্যার জন্য জন্ম নয়!!
আজকাল প্রায়ই শুনতে পাই অমুক স্কুলের, অমুক ক্লাসের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে(পরি ড্রেস বা ল্যাপটপ ইত্যাদি না পেয়ে), নকল করতে না দেয়ায় শিক্ষককে খুন, সন্তান বাবামাকে, মা সন্তানকে, কবুতরের জন্য প্রতিবেশীরর শিশু বাচ্চা খুন এরকম হাজারো দুঃসহ মর্মান্তিক ঘটনা। আমাদের নায়কের মতো ছেলেগুলো বা মেয়েটা জঙ্গি হামলায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
ভাবা যায় ! এমনটা কেন ঘটছে ভাবা প্রয়োজন। কোথায় গেলো আমাদের এত ভালবাসা স্নেহমমতা! বিবেচনাবোধ!
মানবিকবোধ  সততা নৈতিকতা দেশাত্ববোধ চারিত্রিক দৃঢ়তা কোথায় গেল? কেন গেল? নাকি এসব শিক্ষা আজকাল আর দিচ্ছিনা!  বিবেককে জাগিয়ে দিতে হবে। অন্তর থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
আমাদের অহংকারের ৫২, আমাদের গৌরবময় ৭১ এর দিনগুলো এমনি এমনি আসেনি। অনেক অনেক রক্ত, অনেক সম্ভ্রম , অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে মায়ের ভাষা এবং আর বাংলাদেশ নামক দেশটিকে কিনতে হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় হতে তাদের উদ্বুদ্ধ করতেই হবে।
আর এসবই শিখাতে হবে ছোটবেলায়। বার বার হাজারবার শুনাতে হবে সেইসব শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প। জানাতে হবে শ্রেষ্ঠ রূপকারদের নাম , তাদের কথা, তাদের সংগ্রামের ইতিহাস যা অনুপ্রেরণা যোগাবে, বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর করবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে চেনাতে হবে।
বেঁচে থাকাকে আনন্দময় করার মন্ত্র শেখাতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। ভালো মানুষ হবার মন্ত্র শেখাতে হবে। কেবল আত্মমগ্নতা নয় পরহিতে জীবন সুন্দর তাও শেখাতে হবে।
জীবে প্রেম করে যেজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর তাও রপ্ত করাতে হবে।
জানাতে হবে নিজের শেকড়ের কথা,  সংস্কৃতির কথা। বই পড়ার অভ্যাসটা গড়ে দিতে হবে ছোটবেলা থেকেই।
বই পড়ার আনন্দটাও শিখিয়ে দিতে হবে। তবেই পাবে বাঁচার আনন্দ।
রবি ঠাকুর বলেছিলেন মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই, এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মরতে যাবে কেন আমাদের সন্তানরা!
কেনই বা অন্যকে অকাতরে নৃশংসভাবে মারতে যাবে! কিসের অভাব তাদের !
তবে কি কোথায় অপুর্ণতা থেকে যাচ্ছে শিক্ষায় বা শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতিতে ! নিশ্চয়ই।
বাবামা, পরিবার, প্রতিবেশি,বন্ধুবান্ধব, গুরুজন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিটি জায়গা থেকে যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে তো আমাদের সন্তান বিপদগামী হবার কথা না। দু’একটা ব্যতিক্রম ভিন্নকথা।
আসুন আমাদের সন্তানদের বাঁচতে শেখাই, স্বপ্ন দেখতে শেখাই। টাকার পাহাড় গড়তে নয়, মানবিক পৃথিবী গড়তে শেখাই। মানবিক মানুষ হতে শেখাই। খুব সহজ স্বপ্ন দেখাই, আগে ভালো মানুষ হও, তারপর তুমি এগিয়ে যাও সম্মুখপানে। কে রোধে তোমার অগ্রযাত্রা! দেশের সবচেয়ে বড় অংশ অভিভাবক আর শিক্ষক।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো। ” আল্লামা ইকবাল বলেছেন “স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন একজন মিস্ত্রি, যিনি গঠন করেন মানবাত্মা।”
হেনরি এডামস বলেছেন “শিক্ষকের প্রভাব অনন্তকালে গিয়েও শেষ হয় না। “
এখন শিক্ষিত মা বাবা আছে, ভালো উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকও আছে কিন্তু ভালো জাতি তো গড়ে উঠছে না। কেন? এই জায়গায় কাজ করা যেতে পারে , প্রথমে দুর্বলতাগুলো বের করে আনা,তারপর কাজে নেমে পড়লেই নানা অসংগতি দূর করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস ।  চারপাশের অবস্থা দেখে আমার উপলব্ধিটুকু শেয়ার করেছি ।