নয়নাভিরাম দার্জিলিং

।। মো. ফয়সাল ।।
আকাশের ওপরে চকচকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘূর্ণায়মান পাহাড়গুলোর মধ্যে অবস্থিত।এটি বিশ্বজুড়ে দার্জিলিং চা ও চা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। চলতি ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইডসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা ” ২য় ইন্দো বাংলাদেশ স্কাউট ফ্রেন্ডশিপ ক্যাম্প ” দার্জিলিং এর কার্সিয়াং শহরে। বাংলাদেশ থেকে ৩১০ জনের একটি কন্টিজেন্ট ২৬  ফেব্রুয়ারি  ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে মিতালী এক্সপ্রেসের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রায় আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। রাত পৌনে ১০টায় যাত্রা শুরু করে এর পরদিন সকাল ৮টায় নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায় আমাদের ট্রেন। সেখান থেকে জিপ গাড়ির মাধ্যমে প্রায় ২ ঘণ্টা পাহাড়ের আঁকাবাকা উঁচু-নিচু পথ ভ্রমণের আমারা আমাদের নির্ধারিত স্থান কার্সিয়াং শহরে ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার ইনস্টিটিউটে অবস্থান করি। সেখানে পৌঁছার পর আমাদেরকে অভ্যর্থনার মাধ্যমে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়। এরপর সবাই যার যার নির্ধারিত রুমে অবস্থান করি।
 ২য় দিন:
 সকালেই আমাদেরকে জিপ গাড়ির মাধ্যমে দার্জিলিংয়ের কিছু দর্শনীয় স্থান , যেমন : বাতাসিয়া লুপ (Batasiya Loop): দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র  ৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বাতাসিয়া লুপ দার্জিলিংয়ের মনোরম ট্রেন রুট গুলোর মধ্যে অন্যতম। পাহাড়ের শীর্ষ টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেন জার্নি যেকোনো পর্যটকদের জন্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মুগ্ধ করার মতো।
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে (Darjeeling Himalayan Railway)
 ভারতের নিঊ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা ও বাঁকের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা ছোট্ট বাষ্প ইঞ্জিন চালিত ট্রেন দার্জিলিংয়ে পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এ রেলওয়েই একসময় ভারতের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা ছিলো। “দার্জিলিং টয় ট্রেন” হিসেবেও পরিচিত এই ট্রেন জার্নি দার্জিলিংয়ের এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। কোলকাতা ও বলিউডের বিভিন্ন মুভিতে এ ট্রেনের চারপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়।
দার্জিলিং চিড়িয়াখানা (Darjeeling Zoo):
 প্রায় ৬৭.৫৬ একরের এই পার্ক হিমালায়ান পার্ক নামেও পরিচিত। পাহাড়ে অবস্থিত এই পার্কে হিমালায়ান অঞ্চলের স্নো লিওপার্ড, হিমালায়ান নেকড়ে, ক্লাউডেড লিওপার্ড, কালো ভাল্লুক ও রেড পাণ্ডার মতো বিরল কিছু প্রাণীসহ পাখি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের দেখা মিলবে। এই পার্কের ওয়াইল্ড লাইফ মিউজিয়াম আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ পর্যটকদের জন্য।
’ঘুম ’ রেলওয়ে স্টেশন :
 পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে একটির নাম “ঘুম”। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ঘুম রেলওয়ে স্টেশন ভারতের সর্বোচ্চ রেলওয়ে স্টেশন। এটি ২ হাজার ২৫৮ মিটার (৭,৪০৭ ফুট ) উচ্চতায় অবস্থিত ফুট) । জায়গাটি দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের একটি বাঁক, ঘুম মঠ এবং বাতাসিয়া লুপের বাড়ি। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের নির্মাণ ১৮৭৯ সালে শুরু হয় এবং রেলপথটি ৪ এপ্রিল ১৮৮১ সালে ঘুমে পৌঁছে।
মল বা চৌরাস্তা হলো- চারটি ভিন্ন রাস্তার মিলনস্থল এবং দার্জিলিংয়ের হিপ, হ্যাপিং হল। জামা-কাপড় ও মিষ্টি থেকে শুরু করে স্যুভেনির সব কিছু বিক্রি করে এমন দোকানে সারিবদ্ধ, চৌরাস্তা বা মল পর্যটকদের জন্য একটি হটস্পট। এমনকি স্থানীয়দেরও এখানে ভিড় জমাতে দেখা যায়। একটি ক্যাফেতে একটি স্টিমিং কাপপা নিন, অথবা সাধ্যের মধ্যে একটি জায়গার চারপাশে ঘুরে বেড়ান। সেই জায়গাটি যেখানে আপনি স্থানীয় সংস্কৃতির সর্বোত্তম জীবনযাপন করতে পারেন।
 হিমালায়ান মাউন্টেননিয়ারিং ইনস্টিটিটিউট (Himalayan Mountaineering Institute):
বিশ্বের অন্যতম পর্বতারোহন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত. এ ইন্সটিটিউটের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো পর্বতারোহনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে উৎসাহী করা। বিশ্বের অসংখ্য পর্বতারোহী তাদের দক্ষতা বিকাশের জন্য এখানে আসে। আর বর্তমানে পর্যটন স্পট হিসেবেও এই ইনস্টিটিউট যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এটি থেকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
 ৩য় দিন :
 সকালে নাস্তার পর পর এদিন আমাদের জন্য ছিলো সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং এবং প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার সুন্দর একটা সুযোগ। সেটা হলো- ডাওহিল পর্বত। আমাদেরকে একজন দক্ষ গাইডের মাধ্যমে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। শহরের কোলাহল থেকে সামান্য দূরে চলে গেলেই মনে হবে কার্শিয়াংয়ের মতো রমণীয় স্থান পৃথিবীতে একটিও নেই। নীলাভ সবুজ পাহাড়ের সারি, পাহাড়ী ঢালে বিছানো কার্পেটের মতো চায়ের বাগান, মেঘের আড়াল থেকে উঁকিমারা কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য্য আপনাকে বাকরুদ্ধ করে দেবে। কার্শিয়াং থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার ওপরে আছে একটি রহস্যময় পাহাড়। যার নাম ‘ডাওহিল’। নিজের শিঁরদাঁড়ায় ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিতে যেখানে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের দল।
৪র্থ দিন :
চতুর্থ ও সর্বশেষ দিনের যাত্রা শুরু হয় পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু রাস্তা ট্রেকিং করে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি অতিক্রম করে সেন্ট মেরি’স হিলে পৌঁছায় আমাদের রোভার দল। এটি একটি শান্ত এবং মনোরম স্থান। কার্সিয়াং রেলস্টেশন থেকে প্রায়  ৪ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। গ্রামের মাঝখানের প্রধান পাবলিক গোলক, ক্যাথলিক গির্জা ও সেন্ট জন বার্চম্যান চার্চের নামে এর নামকরণ করা হয় । গির্জাটি সেন্ট মেরি’স হিল এবং আশপাশের স্থানগুলোর ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য গ্রামের প্রধান উপাসনালয়। সন্ধ্যায় আমাদের শুরু হয় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্যাম্প ফায়ারের মাধ্যমে আমাদের ক্যাম্পের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এটি ছিলো আমার জীবনের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ক্যাম্প। এর মাধ্যমেই আমি প্রথমবার দেশের বাইরে পা রাখি। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে আগত স্কাউটস বন্ধুদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। সত্যি এটি আমার জীবনের নতুন মাইলফলক।
লেখক: সহকারি রোভারমেট, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ রোভার স্কাউট গ্রুপ।