নাপা সিরাপ নয়, মায়ের দেয়া বিষেই দুই শিশুর মৃত্যু!

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
‘নাপা’ সিরাপে নয়, পরকীয়ায় আসক্ত মায়ের বিষ মিশানো মিষ্টিতেই মৃত্যু হয়েছে দুই শিশুর। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। নিহতদের পিতার রজুকৃত মামলামূলে পুলিশ দুই পুত্রের হন্তারক মা লিমা বেগমকে (৪০) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায়, আপন মা তার পরকীয়া প্রেমিককে নিয়ে মিষ্টির সঙ্গে বিষ খাইয়ে দুই শিশুকে হত্যা করে। পরে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই তাদের খাওয়ানো হয় ‘নাপা’ সিরাপ। গ্রেপ্তারকৃত লিমা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছেন। আর এরই মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে সহোদর দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা নিলো নাটকীয় মোড়।
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় বুধবার (১৬ মার্চ) রাতে নিহত দুই সহোদর শিশুর পিতা ইটভাটা শ্রমিক ইসমাইল হোসেন খান ওরফে সুজন খান বাদী হয়ে স্ত্রী লিমা বেগম, তার পরকীয়া প্রেমিকসহ চারজনকে আসামী করে আশুগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর বৃহস্পতিবার ভোরে দুই সন্তানের ঘাতক মা লিমা বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য দুপুরে তাকে আদালতে তোলা হয়। এদিকে লিমার পরকীয়া প্রেমিক সফিউল্লাহসহ তিনজন পলাতক। গত ১০ মার্চ দুই শিশু সহোদর মোরসালিন ও ইয়াছিনের মৃত্যু হয়।
প্রদত্ত জবানবন্দীতে দুই সন্তান হন্তারক লিমা জানায়, পরকীয়া প্রেমিক সফিউল্লাহ ওরফে মুসার দেয়া বিষ মাখানো পাঁচটি মিষ্টি খাইয়ে শিশু দু’টির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। বিষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানোর পরপরই কৌশলে দুই শিশুকে নাপা সিরাপ খাওয়ানো হয়। পরবর্তীতে প্রচার করা হয় নাপা সিরাপ খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অভিযুক্ত লিমা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। পরকীয়া প্রেমিক মুসা বর্তমানে পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। লিমার স্বামী সুজন খান একটি ইটভাটায় কাজ করেন। লিমা কাজ করেন আশুগঞ্জের একটি চালকলে।কাজের সুবাদে কর্মস্থলের আরেক শ্রমিক সফিউল্লার সাথে পরিচয় হয় লিমার। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে। তারা বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নেয়। পথের বাঁধা সরাতে নিজের দুই সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করে লিমা ও তার প্রেমিক সফিউল্লা ওরফে মুসা। এরই জেরে গত ১০ মার্চ পরকীয়া প্রেমিক মুসার দেয়া বিষ মাখানো পাঁচটি মিষ্টি খাইয়ে শিশু দু’টির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। বিষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানোর পরপরই কৌশলে দুই শিশুকে খাওয়ানো হয় নাপা সিরাপ। পরবর্তীতে প্রচার করা হয় নাপা সিরাপ খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পর সারা দেশে একটি নির্দিষ্ট ব্যাচে প্রস্তুত ওষুধটির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। দেশের নামকরা ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি প্যারাসিটামল গ্রুপের জনপ্রিয় ব্র্যাণ্ড নাপা। পাশাপশি দুই সহোদর শিশুর মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর জেলার সকল ওষুধের দোকানকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নাপা সিরাপ ও নাপা ড্রপ বিক্রি বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানায় জেলা কেমিস্ট অ্যাণ্ড ড্রাগিস্ট সমিতি। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে নির্দিষ্ট ব্যাচের নাপা সিরাপ পরীক্ষায় কোনো ক্ষতিকর উপাদান পায়নি বলে প্রতিবেদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। পরে নিহত শিশুর পরিবার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সন্দেহের দৃষ্টি যায় মিশু দুটির মায়ের দিকে এবং পিতার মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। লিমার পরকীয়া প্রেমিককে গ্রেপ্তারে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।
শিশুদের বাবা ইসমাইল হোসেন খান ওরফে সুজন খান বলেন, ‘শুধুমাত্র পথের কাঁটা দূর করতে লিমা এবং তার পরকীয়া প্রেমিক মুসা বিষ মাখানো মিষ্টি খাইয়ে আমার নিষ্পাপ দুই ছেলেকে হত্যা করেছে। পরবর্তীতে বলা হয় নাপা সিরাপ খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। গত ছয় মাস ধরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক চলছে। ঘটনার দিন আমি সিলেট ছিলাম। ফাঁকা বাসায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেদের হত্যা করা হয়। আমার ছেলেদের হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দাবি করছি।’
আশুগঞ্জ থানার পরিদর্শক (ওসি) আজাদ রহমান জানান, অভিযুক্ত লিমা বেগমকে তার স্বামীর দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে লিমা জানায়, মুসা নামে এক শ্রমিকের সঙ্গে তার দীর্ঘ ছয় মাস ধরে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক চলছে। ঘটনার দিন বিকেলে প্রেমিক মুসা বিষ মাখানো মিষ্টি দিয়ে গেলে তা শিশুদের খাওয়ানোর পর নাপা সিরাপ খাওয়ায়। এতে করে নাপা সিরাপ খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করে তাদের মা। এ বিষয়ে একটি হত্যা মামলা হয়েছে।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিষ্টির সাথে বিষ মিশিয়ে দুই শিশু ইয়াছিন ও মোরসালিনকে হত্যা করে মা লিমা বেগম। মৃত্যুর ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই নাপা সিরাপের রিঅ্যাকশন হয়েছে বলে প্রচার করে। কিন্তু লিমার আচরণে প্রথমেই পুলিশের সন্দেহ হয়। অধিকতর জিজ্ঞাসায় সে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় লিমার প্রেমিক সফিউল্লাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’