পিতাহারা তিন সন্তানকে শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রাম

মহসীন কবির।।

শাসন ও সোহাগের মিশেলে সন্তানদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারাই একজন আদর্শ মায়ের বৈশিষ্ট্য। অবশ্য দাম্পত্যের উড়ন্ত সময়ে শিশু সন্তানদের রেখে স্বামীর চির প্রস্থান নারীর জন্য চ্যালেঞ্জ। জীবনের অনিশ্চয়তা বিবেচনায় অন্যত্র বিয়ে করতে বাবার বাড়ির চাপ, অন্যদিকে সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ- এ দোটানায় তার জন্য
সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। তারপরও অনেক সময় মায়েদের ত্যাগ, প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তায় সন্তানের ক্যারিয়ার সুনিশ্চিত হয়। তাই মাকে হতে হয় নীলকণ্ঠ। হতাশা, গ্লানি ও রক্তচক্ষু হজম করেই তাকে এগিয়ে যেতে হয়। এমনটিই জানালেন স্কুলশিক্ষিকা সুনীতি রাণী বিশ্বাস। তিনি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ৮৬ নং নোয়াপড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন উপজেলার দোঘই গ্রামে। তার বাবা শীতল
চন্দ্র বিশ্বাস ও মা কামিনী সুন্দরী বিশ্বাস। শৈশবেই ১৯৭০ সালে হারিয়েছেন বাবাকে। তাই একরকম সংগ্রাম করেই বড় হয়েছেন। জানালেন নানা চড়াই-উৎরাই এবং আর্থিক টানাপোড়েনেও নিজের ক্যারিয়ারকে সমুন্নত রেখেছেন। ১৯৮১ তে এসএসসি ও ১৯৮৩ সালে এইচএসসিতে করেছেন কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল। এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালে যোগ দিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিতে। অবশ্য তারও আগে দায়িত্ব পালন করেছেন নার্সিং ও হেলথ ভিজিটর হিসেবে।চাকরি জীবনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শাখায়
সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।  ১৯৮২ সালে পাঠ্য জীবনেই বাঁধা পড়েন সাত পাকে। বর একই উপজেলার দৌলতপুরের নিখিল দেওয়ানজী। তিনিও ছিলেন হাইস্কুল শিক্ষক। জড়িত ছিলেন রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। তবে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে পরলোকগমন করেন তিনি।
সুনীতি রাণী বিশ্বাস জানান, স্বামীর আকস্মিক চলে যাওয়ায় জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন। কারণ তখন তাদের তিন সন্তান সবেমাত্র পড়াশুনা করছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের চাকরির সুবাদে যে বেতন পেতেন, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার খরচ চলতো। এক সময় সন্তানদের পড়াশুনার খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস করতেন বিন্দু বিন্দু জল থেকেই সৃষ্টি হয় হয় মহাসিন্ধু।তাই সন্তানদেরকে
প্রতিষ্ঠিত করতেই তার সব চেষ্টা। নিজের চাকরির পাশাপাশি দুই হাতে সংসারও সামলিয়েছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে তার চলার পথ কখনও ফুল বিছানো ছিলো না।কতিপয় প্রতিবেশীর হিংসা-বিদ্বেষ, অবহেলা ও আর্থিক দৈন্যতায় অনেক সময় হাপিয়ে পড়তেন। তবে তার ইচ্ছে ছিলো সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করবেন। সে অনুযায়ী তাদের ভালো-মন্দ ও সুখে-দুঃখে তিনিই পালন করেন নিয়ামক ভূমিকা। বুঝতে দেননি বাবার অভাব। শত ব্যস্ততায়ও আগলে রেখেছেন সন্তানদের। তিনি চেয়েছিলেন স্বামী ও নিজের মতো সন্তানদেরও শিক্ষক বানাবেন। তার সে স্বপ্ন পূরণও হয়েছে। জানালেন স্বামী মারা যাওয়ার সময় বড় মেয়ে লীনা রাণী এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে সে এখন ফেনী কলিমুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে।  মেঝ সন্তান নয়ন দেওয়ানজী ৮ম শ্রেণিতে
থাকাকালীন বাবা হারালেও ভিক্টোরিয়া থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষকতা করছেন বরুড়া উপজেলার শাহেরবানু স্কুল অ্যান্ড কলেজে। করছেন সাংবাদিকতাও। অন্যদিকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে বাবার আদর বঞ্চিত পার্বতী দেওয়ানজীও ভিক্টোরিয়াতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে লক্ষ্মীপুর শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
সুনীতি রাণী বিশ্বাস বলেন, জীবনে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও দৃঢ়তা হারাননি।তাই সন্তানদের মানুষ করতে পেরেছেন। সন্তানরাও কখনও তার সাথে রূঢ় আচরণ করেনি। তাই তিনি এখন জীবনের সোনালী অধ্যায় অতিক্রম করছেন। স্কুলের পাশাপাশি ধর্ম-কর্ম পালন করছেন। অবসরে সময় কাটান বাসার ছাদের ফুল বাগানে।বর্তমানে তার খুনসুঁটি হয় একমাত্র ছেলে নয়ন দেওয়ানজীর ছেলে ‘নম্র’ এর সাথে। তিনি মনে করেন আদর্শ মা হতে হলে নিজের মধ্যে নীতি ও আদর্শ লালনের পাশাপাশি সন্তানদেরও এধরনের শিক্ষা দিতে হবে।

তাঁর মেঝ সন্তান ও স্কুল শিক্ষক নয়ন দেওয়ানজী বলেন, তাদের মায়ের ত্যাগ ও আত্মবিশ্বাসের কারণেই তারা আজ গর্বিত শিক্ষক পরিবার।