পৌনে এক শতাব্দী টিকে থাকার নেপথ্যে.

মহসীন কবির ।।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ’সাপ্তাহিক আমোদ’ একটি বিস্ময়কর নাম। এখন পর্যন্ত এটিই দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৫৫ সালের ০৫ মে কুমিল্লার পরিশীলিত সাংবাদিক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ’আমোদ’ নামক যে চারা গাছটি রোপন করেছিলেন, গত পৌনে এক শতাব্দীতে তা বিরাট বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। কারণ শুরুতে এটি ছিলো একটি ক্রীড়া বিষয়ক পত্রিকা। পরবর্তীতে পাঠকের চাহিদার আলোকে ধাপে ধাপে একটি সর্বজনীন পত্রিকায় রূপ পায় আমোদ। সাদা কালো থেকে হয় রঙিন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো থেকে মনোনীত এশিয়ার ৫টি সফল আঞ্চলিক সংবাদপত্রের তালিকায় স্থান পায় ’আমোদ’।
একটি আঞ্চলিক পত্রিকা হলেও নিজস্ব সত্ত্বা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে পত্রিকাটি। যেখানে সমসাময়িক অনেক পত্রিকা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেখানে ’আমোদ’ এর মতো পত্রিকা এতো বছর টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। মূলত বস্তুনিষ্ঠতা ও জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। পত্রিকাটির এক শ্রেণির নিবেদিতপ্রাণ নিয়মিত পাঠক রয়েছেন। যারা বাজারের শত চাকচিক্যতাপূর্ণ পত্রিকার ভিড়েও প্রতি সপ্তাহে ’আমোদ’-এর জন্য মুখিয়ে থাকেন। এই পত্রিকাটি না পড়লে যেন তারা অতৃপ্ত থাকেন। এমনও পাঠক রয়েছেন, যারা কোনো কারণে বাসায় পত্রিকাটি না পেলে পুরাতন চৌধুরীপাড়ার কার্যালয়ে চলে আসেন। তাছাড়াও পেশাদার সাংবাদিকদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মাঝেও এর প্রকাশনার ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে।
আমোদ প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীকে যারা দেখেছেন,তাদের কাছ থেকে শুনেছি তিনি পত্রিকা প্রকাশকে এক ধরনের আনন্দ মনে করতেন। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্টরা এক ধরনের সৃষ্টিশীলতার উল্লাস অনুভব করবেন। আর পাঠকরা নতুনত্বের উচ্ছ্বাসে আমোদিত হবেন। সেই বোধ থেকেই এর নাম দিয়েছেন ’আমোদ’।
যতটুকু জানি কুমিল্লার বেশিরভাগ সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতার হাতে খড়ি হয়েছে সাপ্তাহিক ’আমোদ-’ এর মাধ্যমে। এখান থেকে শিখে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হয়েছেন কেউ কেউ। শুধু তাই নয়, আমোদের কল্যাণে সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর পুরো পরিবারের সদস্যরাও সাংবাদিক হতে পেরেছেন। কারণ আমোদ প্রকাশের আগের দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি এর কাজ করতেন। কেউ লিখতেন, কেউ বানান দেখতেন। আবার কেউ মেকাপ ও পেস্টিং করতেন। যে কারণে পরিবারটি এক সময়ে সাংবাদিক পরিবার হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী মারা গেলেও পত্রিকাটির প্রকাশনায় বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হয়নি। তার তৈরি করা সাংবাদিকদের পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তানদের যৌথ প্রয়াসে পত্রিকা চলছে তার নিজস্ব গতিতে। তাঁর মৃত্যুর পর এর সম্পাদকের দায়িত্ব পান সহধর্মিনী শামসুন্নাহার রাব্বী। পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর পর পত্রিকাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরী বাকীন এম এ রাব্বী। তার দিকনির্দেশনায় প্রতি বৃহস্পতিবার পত্রিকাটির পুরোপুরি প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করছেন আরেক আপাদমস্তক সাংবাদিক মহিউদ্দিন মোল্লা। যার তারুণ্যের বেশিরভাগ সময় কেটেছে আমোদ-এর সাথে। বলা যায় তিনিও মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী পরিবারের একজন সদস্য। তিনি এখন আমোদ এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
ছাত্র জীবনে দৈনিক আমাদের কুমিল্লার সাথে জড়িত ছিলাম ছয় বছর। সেখানে আমার সাংবাদিকতার দিকনির্দেশক ছিলেন শাহাজাদা এমরান ও মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই। আমি মনে করি এমন কিছু নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী তৈরি করতে পারাটা আমোদ এর স্বার্থকতা।
ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র জীবনে আমোদ-এর সাথে আমার তেমন পথচলা ছিলো না। তবে মাঝে-মধ্যে আমার দুই একটি লেখা ছাপানো হতো। এরপর মাঝে ৬ বছর ঢাকায় যুগান্তর ও যমুনা টিভিতে থাকাকালীন বিভিন্ন দিবস ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মোল্লা ভাই লেখা চেয়ে নিতেন। আমোদ-এর সাথে আমার সম্পর্ক এতটুকুই ছিলো। তবে এর সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হই ২০২৩ সালের জুলাই থেকে। ঢাকা থেকে পুনরায় কুমিল্লায় ফেরার পর এক ধরনের বিষণœতায় ভুগতাম। পরবর্তীতে দেখলাম আমোদকে কেন্দ্র করে এক ধরনের তরুণ সাংবাদিকদের একটি চৌকস টিম। যারা আমাদেরই অনুজ অথবা অগ্রজ। তারা অন্য জাতীয় গণমাধ্যমেও কাজ করেন। আবার আমোদ-এ সময় দেন। আমিও তখন ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে কাজ করছি। একদিন মোল্লা ভাই বললেন আমোদ-এ আসো। সেখানে সাংবাদিকদের আড্ডা হয়। কথা মতো গেলাম। ঠিকই কয়েক দিন যাওয়ার পর নতুন করে আমোদ-এর প্রেমে পড়ে গেলাম। দেখলাম আমোদ ও রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম কেন্দ্রিক এক ধরনের শক্তিশালী সাংবাদিকদের টিম রয়েছে। এক সময় আমিও আমোদে প্রত্যেক সপ্তাহে লিখা শুরু করলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা নিউজের কাজে এক সাথে যেতাম। বিভিন্ন উপলক্ষে একসাথে আড্ডা-খাওয়া ও ট্যুরে যাওয়া। সবকিছুই যেন অন্যরকম।
এই সময়ে অগ্রজদের মধ্যে খায়রুল আহসান মানিক, মোবারক হোসেন, মহিউদ্দিন মোল্লা ও মাহফুজ নান্টু ভাইয়ের সান্নিধ্য চমৎকারভাবে উপভোগ করেছি। আর অনুজদের মধ্যে তৈয়বুর রহমান সোহেল, ইলিয়াস হোছাইন, মহিউদ্দিন আকাশ, মোহাম্মদ শরীফ,অমিত মজুমদার, সাইফুল ইসলাম সুমন(সুমন পাটেয়ারী), আবু সুফিয়ান রাসেল, আব্দুল্লাহ আল মারুফ, হাসিবুল ইসলাম সজিব ও আল আমিন কিবরিয়ার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। পেশাগত দায়িত্বের কারণে হয়তো আবারও ঢাকায় ফিরতে হয়েছে। কিন্তু আমোদ পরিবারের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো চরমভাবে মিস করি।
আরেকটি কথা না বললেই নয়, মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই সবাইকে নিয়ে ’আমোদ’কে আরও এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। আর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন বাকীন ভাই ও তারিকা রাব্বী আপা। তারাও বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে ভালোবাসায় রাখেন। তাদের জন্য শুভ কামনা। আরও শুভাশিষ ছোট্ট সিয়াম ও তার বাবা আলমের প্রতি। যারা আমাদের সব আয়োজনে অনেক কষ্ট করে থাকেন।
আমোদ-এর ৭০তম প্রতিষ্ঠবার্ষিকীতে পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ও তাঁর সহধর্মিনী প্রয়াত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাসুন্নাহার রাব্বীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন।
