চন্দনা : শৈশবের উঠোনে জীবনের গান

মনোয়ার হোসেন রতন।।
চন্দনা। কুমিল্লা লাকসাম উপজেলার প্রাণ কেন্দ্র থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি নিরিবিলি সবুজে ঘেরা গ্রাম। এই জনপদ যেন প্রকৃতির কোলে, লুকানো এক মানবিক স্বর্গ। গ্রামের নামটি উচ্চারণ করলেই হৃদয়ে বাজে স্মৃতির সুমধুর সুর। চন্দনা কেবল একটি নাম নয়, এটি ভালোবাসা, এটি শিকড়, এটি আমাদের শৈশবের প্রাণ।
আমার বেড়ে ওঠার আখ্যানের কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে এই চন্দনা গ্রামের ‘বড় বাড়ি’ – আজিজুন্নেসা বেগম ও স্কুল ইন্সপেক্টর সেকান্দর সাহেবের পরিবার। এ একান্নবর্তী বাড়িটি যেন ছিল আত্মার আত্মীয়তায় গড়া এক মানবিক দুর্গ। ওনারাই ছিলেন আমার নানু এবং নানা। আমার নানু ছিলেন এক অসাধারণ নারী, গ্রামবাসী এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য যার ভালোবাসা ছিল নিঃস্বার্থ। আর তাঁর দৃষ্টি ছিল মমতায় দীপ্ত। নানাকে আমরা অনেকেই দেখিনি, তবে জেনেছি তিনি ছিলেন, ধার্মিক, প্রজ্ঞাবান, আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক বিশিষ্ট ব্যক্তি।
এ পরিবারের সন্তানরা ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় খালা জাহানারা বেগম, আমার মা হোসনে আরা আর ছোট খালা মনোয়ারা বেগম তাঁরা তিনজনেই ছিলেন শিক্ষিত, সচেতন এবং স্নেহময়ী।
আমার বড় খালু ছিলেন, এশিয়া উপমহাদেশের বিখ্যাত স্টিল মিলের কর্মকর্তা। আমার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ব্যাংকের ব্যাংকার। আর আমার ছোট খালু ছিলেন বাংলাদেশ তার ও টেলিযোগাযোগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
আমার বড় মামা গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ছিলেন সাংবাদিকতা পেশায় এক আলোকিত নাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও যিনি সোচ্চার ছিলেন কলম যোদ্ধা হিসাবে। ছোটমামা গোলাম সারোয়ার চৌধুরী ইংল্যান্ডের রয়েল হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বড় মামি হাসিনা চৌধুরী ছিলেন শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। ফরিদা বিদ্যায়তনের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা। আর ছোট মামি সাকিনা সারোয়ার বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম প্রযোজিকা এবং বাঙালি নারীর আত্মপ্রকাশের এক অনন্য প্রতীক।
এই বড় বাড়িতে বেড়ে উঠা আমাদের জন্য ছিল এক আশীর্বাদ। সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গা পাখির ডাক, উঠোন জুড়ে খেলার কোলাহল, দুপুরে আম কুড়ানো, বিকেলে পুকুরে ঝাপা ঝাঁপি – এ সব ছিল জীবনের অলিখিত সুখ পাঠ। শীতের সকালে নানুর হাতে খেজুরের রস আর টুনি খালার গরম পিঠার স্বাদ এখনো মনে পড়ে – যেন হৃদয় মিঠে মিঠে শীতল বাতাস বয়ে যায়।
বর্ষার দিনে খালপাড়ের সেই নৌকার ভ্রমণ, সন্ধ্যার পর গল্পের আসর, গ্রাম্য নাটক, বৈশাখী মেলা, উত্তরদা স্কুল মাঠ এ সব আমাদের জীবনের রং ছাড়িয়েছে, যে রং কোন ডিজিটাল পর্দায় ফুটে ওঠে না। আমাদের শৈশবের সেই সাদামাটা দিন গুলো ছিল বিশুদ্ধ, নির্ভেজাল আর স্বর্গীয়।
চন্দনার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম কৃষ্ণপুর, রামপুর, মনপাল, ঠেঙ্গারপাড়সহ প্রায় সব স্বজনরাও আমাদের শৈশবের অংশ, আমাদের শৈশবের ঘরবাড়ি। মালেক মামা, সাংবাদিক জলিল মামা, কবির মামা, তাহের মামা, সাঈদ মামা, মাইনুদ্দিন মামাসহ প্রায় সবার সান্নিধ্য আমাদের বুদ্ধিভিত্তিক ও মানবিক চর্চার ভিত গড়ে দিয়েছে।
চন্দনা ছিল আমাদের কাছে এক শিক্ষালয়, যেখানে মানবিক মানুষ হবার শিক্ষা পেয়েছি। যেখানে প্রতিটি দিন ছিল গভীর ও আন্তরিক।
এ দিনে ফিরে তাকালে দেখি, আমাদের শৈশবের উঠোন জুড়ে লেখা আছে জীবনের অমূল্য পাঠ। চন্দনার সেই দিন গুলো আজ আর নেই, অনেকেই নেই। অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে চন্দনা শিকড় আজও জড়িয়ে আছে হৃদয়ের গভীরে। আমাদের ‘বড় বাড়ির’ উঠোন, আমাদের শৈশব, আমাদের স্মৃতি – সব কিছু মিলে চন্দনা আমার কাছে শুধু একটি গ্রাম নয় বরং এক আত্মার ঠিকানা।
লেখক:কবি ও সাহিত্যিক।
