প্রাণ ফিরে পাচ্ছে কুমিল্লা বিসিক

তৈয়বুর রহমান সোহেল।।

করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায় ধস নামাতে শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাওয়ায় তারা ব্যবসা বন্ধ করে দেন। ১৩০টি সচল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৩২টি চালু থাকে, ৯৮টি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বিসিক কুমিল্লার ১৩০টি সচল প্রতিষ্ঠানে পুনরায় উৎপাদন শুরু হয়েছে।

সরকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংকট কাটাতে ২০ হাজার কোটি টাকার শিল্প ঋণের প্যাকেজ ঘোষণা করে। কম সুদে দেওয়া ওই ঋণের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে কুমিল্লা জেলা। চট্টগ্রাম বিভাগে চট্টগ্রমের পর এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ওই ঋণ কার্যক্রম কমিটিতে বিসিক কুমিল্লাকে রাখা হয়েছে। ওই ঋণের বাইরে সম্প্রতি বিসিক কুমিল্লার জন্য ১০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। যা বিসিক কুমিল্লা কর্তৃপক্ষ সরাসরি বণ্টন করবে। ব্যাংকের সাথে লিঁয়াজো করে তারা এ ঋণ সহায়তা দিবেন। সহজে ব্যাংক ঋণ পাওয়া, বড় ঋণ সহায়তার আশ্বাস এবং করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন হওয়াতে পুনরায় সচল হয়েছে এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান।
মেসার্স আক্তার টেডার্সের স্বত্বাধিকারী আক্তার হোসেন জানান,‘খুব সহজে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার জন্য বিসিক কর্তৃপক্ষ সহায়তা করছে। তাই প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে সমস্যা হচ্ছে না।’
আশেক ফুড এন্ড মিলিং ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপক শরীফুল ইসলাম জানান,‘করোনার সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়নি। বিসিক কর্তৃপক্ষ নিয়মিত মনিটরিং করেছে।’
১৯৬০-১৯৬১ সালে ৫৪ দশমিক ৩৫ একর এলাকায় স্থাপিত হয় বিসিক কুমিল্লা অঞ্চল। যাতে ব্যয় হয় ৮৪ দশমিক ১৮লাখ টাকা। এতে মোট প্লট সংখ্যা ১৫৫টি। ৬টি প্লটের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক ভবন ও ওয়াটার ট্যাঙ্ক। বাকি ১৪৯টি শিল্প প্লটে ১৪২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে। এর মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠান রুগ্ণর তালিকায়, একটি নির্মাণাধীন। তিনটিতে রয়েছে মামলা জটিলতা। সচল থাকা ১৩০টি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কাজ করছেন সাত হাজার ৭১৪ জন। যার মধ্যে তিন হাজার ৯৪৩ জন পুরুষ ও তিন হাজার ৭১১জন নারী। বাংলাদেশের ৮টি পুরোনো বিসিকের মধ্যে কুমিল্লা একটি। এ,বি,সি,ডি ও এস; এ পাঁচ ক্যাটাগরির প্লট বরাদ্দ আছে। সর্বনিম্ন ৩হাজার ও সর্বোচ্চ ২৫হাজার বর্গফুটের প্লট আছে বিসিকে। প্রতি বর্গফুট ৬৫৬ টাকা করে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় জেলা প্রশাসন।

বিসিক কুমিল্লায় রয়েছে একাধিক স্টিল মিল, বেকারি, আয়ুর্বেদিক তৈরির কারখানা, আটা ও পাটজাত পণ্য তৈরির কারখানা, অ্যালুমিনিয়াম, সিলভার ও প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কারখানা এবং কয়েকটি টেক্সটাইল।
বিসিক কুমিল্লা জেলার উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. রোকন উদ্দিন বলেন,‘বন্ধ থাকা রুগ্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু হলে এবং বিসিকের জন্য বরাদ্দ ঋণ কার্যক্রম দ্রুত শুরু করে দিতে পারলে বিসিক কুমিল্লায় সর্বসাকুল্যে ১৫হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এটা বিরাট ব্যাপার।’
তিনি জানান,‘ যে ১০০ কোটি টাকা বিসিক কর্তৃপক্ষ সরাসরি বিতরণ করবে, তা অল্প সময়ের মধ্যে শুরু করা যাবে। কার্যকরী কমিটির মিটিংয়ের পর রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও কমে আসবে। সুতরাং খুব সহসাই বিসিক কুমিল্লার আমূল পরিবর্তন ঘটবে।’

এদিকে বিসিকে ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ যারা নিয়েছেন, তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ দেওয়া হচ্ছে। দুই থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত এ ঋণ সহায়তা দেওয়া হবে। বিসিক কুমিল্লার সুপারিশের ভিত্তিতে এ ঋণ দিয়ে থাকে কর্মসংস্থান ব্যাংক। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে এ ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মসংস্থান ব্যাংক কুমিল্লা শাখার ব্যবস্থাপক খায়রুল আলম কবির। তিনি জানান, ‘২০২০ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রশিক্ষণ নেওয়া ১৮-৩৫বছর বয়সী তরুণরা শর্তসাপেক্ষে ঋণ নিতে পারবেন। শুরুতে আমরা দুই লাখ টাকা দিয়ে থাকি। শর্ত ঠিকভাবে পূরণ করতে পারলে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হয়।’
বিসিক কুমিল্লা থেকে এ পর্যন্ত ৩৬২ জন ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিসিক কুমিল্লার সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিরা পাচ্ছেন কর্মসংস্থান ব্যাংকের ঋণ। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৩৩২জন। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে ৬ মাস মেয়াদী কম্পিউটার অ্যান্ড গ্রাফিক্স ডিজাইনং কোর্স; যাতে ফি দিতে হয় এক হাজার ২৫টাকা, ৪মাস মেয়াদী ইলেকট্রিক অ্যান্ড হাউজ ওয়্যারিং কোর্স; যাতে ফি ৬২৫ এবং ৩মাস মেয়াদী ফ্যাশন ডিজাইন ও ফুড; ফি দিতে হয় ৫২৫টাকা। পাশাপশি ৫০টাকা খরচে পাঁচদিন ব্যাপী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বিসিক কর্তৃপক্ষ।
বিসিক কুমিল্লার সীমাবদ্ধতা:
১৯৬০-১৯৬১ সালে পুরোনো কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠাতে বিসিক কুমিল্লার আয়তন বাড়েনি। দ্রুত নগরায়ণের ফলে আশেপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন। ভবিষ্যতে আয়তন বাড়ানোর চিন্তা আপাতত বাদ দিতে হয়েছে বিসিককে। এদিকে সিটি করপোরেশনের ভিতরে গড়ে উঠলেও বিসিক কুমিল্লা একটি স্বতন্ত্র শিল্পাঞ্চল। এ কারণে বিসিকের উন্নয়নে তেমন কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না সিটি করপোরেশন। বরং সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিসিকের পরিবেশ। এখানে পরিবেশ দূষণের নিয়ম না থাকলেও মোট চারটি ডাস্টবিন থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে নিয়মিত। এসব ডাস্টবিন পরিষ্কারে কারও কোনও উদ্যোগ নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। ভারী বর্ষায় বিসিকের দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে যান চলাচল ও শ্রমিকদের যাতায়াতে মারাত্মক দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়।

বিসিক কুমিল্লার উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. রোকন উদ্দিন বলেন,‘ জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণের সমস্যাটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে ৬ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ হয়েছে। কাজ শুরু হলে জলাবদ্ধতা কমে আসবে। তবে নগরায়ণ যেভাবে হয়েছে, আমরা চাইলেও পানিগুলো বের করে দিতে পারবো না। কারণ, বিসিকের বাইরে অশোকতলা ও ধর্মপুর এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে কয়েকটি হাউজিং গড়ে উঠেছে। সেখানে পানি বাধাপ্রাপ্ত হবে। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে সিটি করপোরেশনকে সহায়তার অনুরোধ করেছি। আমরা, সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগে বিসিকের সমস্যা সমাধান করতে পারবো।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন,‘ আমার জানামতে বিসিক এলকায় একটি ডাস্টবিন আছে। এটা নিয়মিত পরিষ্কার করছি। অন্য কোথাও ডাস্টবিন থাকার বিষয়টি কেউ আমাকে অবগত করেনি। জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা ব্যাপক কাজ করছি। বিসিকের পানি ধর্মপুর তোহা হাউজিংয়ে এসে আটকা পড়ে। মে মাস পর্যন্ত আমরা ড্রেনের কাজ চালিয়ে যাবো। আশা করি, এবার কোনও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে না।’