বই-বউ দুটোই আমার প্রিয়! — মতিন সৈকত

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার আদমপুর গ্রামে আমার জন্ম। বাবা প্রখ্যাত সমাজ সেবক মোঃ কেরামত আলী ক্বারি সাহেব। তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা ঈদগাহ কবরস্থান এবং দুস্থজনের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ জমি দান করে গেছেন। মা সাহানারা বেগম গৃহিণী। পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি পঞ্চম। ইতিমধ্যে বড় ভাই অধ্যক্ষ এম এ লতিফ, বড় বোন জোবায়দা বেগম এবং আমার পিঠাপিঠি ছোট বোন রাশেদা আক্তার পরপারে চলে গেছেন। মা শতায়ু। কয়েক বছর ধরে শয্যাশায়ী। বিছানায় সব কার্যক্রম সম্পাদন করেন। আমার দৈনন্দিন কর্মসূচি মায়ের কাঁথা কাপড় ধোয়া, শুকনো, বিছানা ঝাড়ু, মোছা, অযু-গোছল করানো এবং নিয়মিত খাইয়ে দেয়া। আমার স্ত্রী শিরিন আক্তার আল্লাহর রহমতে সব দায়িত্ব পালন করেন। আমি বাড়ির অন্যান্য কাজে মেহমান, তিনি মেজবান। বাইরের কাজে আমার সময় চলে যায়। ছেলে ফায়সাল সাকির কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। মেয়ে রুবাইয়াত সিলমী জান্নাত অনার্স শেষ বর্ষে। জামাই এমবিবিএস ডাক্তার।
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশোর, যৌবন গ্রামেই। বাকি দিনগুলো আল্লাহ’র ইচ্ছায় এখানেই কাটাতে চাই।
বাবা আমার প্রিয় আদর্শ। তিনি বলতেন পাঁচে পদে মানুষ হতে হবে। মসজিদে গেলে ইমামতি করতে হবে, জমিনে গেলে হাল চাষ করতে হবে, শালিসে গেলে সাবস্ত করতে হবে, সমাবেশ গেলে বক্তব্য দিতে হবে, সবসময় মানুষের খেদমত করতে হবে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আনুষ্ঠানিক ভোটের মাধ্যমে সিংগুলা ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। যার সাথে নির্বাচন করেছি সে বড় ভাই ছিলেন ফাজিল ক্লাসের আর আমি অষ্টম শ্রেণির। তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৩৮ ভোট। আমি ১৩৮ ভোট। কৈশোরের সফলতা সারাজীবন আনন্দ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় একটি জাতীয় শিশু কিশোর তরুণ সৃজনশীল সংগঠনের সমন্বয়ক প্রধান নির্বাচিত হয়েছি মাত্র ১ ভোটের ব্যাবধানে। সুস্বাস্থ্য নির্মল পরিবেশ, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন, নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন নিয়ে কাজ করে আইপিএম-আইসিএম ক্লাব। দাউদকান্দি উপজেলা দেশের বৃহত্তম আইপিএম মডেল উপজেলা। ২০০০ সালের দিকে আইপিএম-আইসিএম ক্লাবের ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। ১৫৪ টি আইপিএম-আইসিএমক্লাবের সমন্বয়ে প্রায় ১০,০০০ কৃষক নিয়ে সে সময়ে আমরা প্রতিষ্ঠা করি দাউদকান্দি উপজেলা কেন্দ্রীয় আইপিএম-আইসিএম ক্লাব। কয়েক দফা বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিক নির্বাচনে আমি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। তিন গ্রামের তরুণ যুবকদের নিয়ে ১৯৮৭ সনে প্রতিষ্ঠা করি আদমপুর, পুটিয়া,বিটমান আদর্শ যুব সংঘ ( পিএবি ক্লাব।) দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় কবিতা লেখা জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্যারের ডাকযোগ অভিনন্দনপত্র পাই। এটাকে এখনএ জীবনের বড় পুরস্কার মনে করি। সে সময়ে ১২টি কবিতা দিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করি। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ৩৩ টি কবিতা দিয়ে অলংকার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করি। মুক্তি চাই, তোমরাতো সুখেই আছো গল্প গ্রন্থ বের করে আর কোন উদ্যোগ নেইনি। ৮০’র দশক থেকে লেখালেখি করলেও নব্বইয়ের দশকের গল্পকার এবং সাহিত্য সংগঠক হিসাবে ঢাকায় ব্যাপক পরিচিত ছিলাম। সে সময়ে জাতীয় দৈনিকে আমার গল্প, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। আমার সভাপতিত্বে অতিথি হয়েছিলেন কবি আল মুজাহিদী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলী ইমাম, সাইয়েদ আতেকসহ আরে অনেকে। ১৯৯০ সালে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হযেছি। বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি পাড়াপড়শীর উৎকণ্ঠা ছিল সারাজীবন মনে রাখার মত। আমার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়।
সে সময়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট কবি মোহাম্মদ রফিকুর রহমান দোয়া নামের কবিতাটি লিখে পাঠান।
১৯৯০ সালে প্রথম রক্ত দেই রেড ক্রিসেন্টে। সে সময়ে রক্ত দেয়া ভীতিকর ছিল। এখনকার মত এত ব্যাপক জনপ্রিয় এবং সেবামূলক কার্যক্রম এবং উৎসাহ হিসেবে তরুণ প্রজন্ম গ্রহণ করেনি। বইয়ের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। বই পড়া, বই কিনা, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা রক্তের সাথে মিশে গিয়েছিলো। ঢাকার অধিকাংশ পাঠাগারের সাথে ছিল সংখ্যতা। লেখালেখির প্রতি অগাধ মমতা। জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতা, শিশুতোষ পাতা ছিল মূল আকর্ষণ। পত্রিকার অফিসে আড্ডা শেষে রাতে যখন রাস্তায় হেঁটেছি তখন ফাঁকা রাস্তা, বলা চলে নির্জন নিরিবিলি। গ্রামে থাকলে ঘুম থেকে জেগে মধ্যরাতের জল বিয়োগ করতে উঠতাম।
সভা-সমাবেশ,সেমিনারের প্রতি ছিলাম আকৃষ্ট। বাড়ির প্রতি আপাদমস্তক মমতা অক্ষুন্ন আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে বি, এ অনার্সসহ এম পাশ করি ১৯৯৩ সালে। আমাদের সময় ছিল সেসনজটের সময়। উচ্চ শিক্ষা ছিল উচিত শিক্ষা। ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের সময় বি, এ অনার্সে ভর্তি হই। তারপরে এলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তিনি মেয়াদ পূর্ণ করে চলে গেলেন। এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর সেশনজট শেষ করে আমরা বেরুলাম ৯৮ তে। ভাগ্য ভালো বাবা আমাকে ৯৬ তে বিয়ে করিয়ে বউ দিয়ে গেলেন। ৯৭ তে হজ আদায় করার পর আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। আমার বিয়ে উপলক্ষে সে সময়ে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান প্রখ্যাত গীতিকার কবি সিরাজুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক শাহেদ আলী। শুভেচ্ছা বার্তার পাশাপাশি তিনি কবিতা পাঠান।
-বই-বউ দুটোই আমার প্রিয়। বাড়িতে থেকে ৯৮ সালে অধ্যাপনা শুরু করলাম। কৃষি, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন, খাল-নদী পুনঃখনন, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন, নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন, প্লাবনভূমিতে সমাজ ভিত্তিক সমবায় পদ্ধতিতে গণশেয়ারের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বোরোধান আবাদে সঠিক রেখে মাছ চাষ সম্প্রসারণ, পাখি উদ্ধার, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সিটিজেন ফার্টিলাইজার বা নাগরিক সার রুপান্তর কার্যক্রম, সবুজায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ বহুমুখী কার্যক্রম যাপিত জীবন। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ২০১০ এবং ২০১৭ সালে কৃষিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে দেশসেরা একক ব্যক্তি হিসেবে ২০২১ সালের জাতীয় পরিবেশ পদক। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা কর্তৃক সংবর্ধনা ও সম্মাননার পাশাপাশি পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। আলহামদুলিল্লাহ। চাই আল্লাহর খাছ রহমত, বরকত মাগফিরাত।
লেখক, জাতীয় পরিবেশ পদক এবং দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত।