অসম্পূর্ণ-তবুওতো জীবন!– ইলিয়াস হোসাইন

 

এক.
আকাশে শ্রাবণের ঘনঘটা নীল-সাদা মেঘ! নিচে বহমান স্রোতস্বিনীর খরস্রোতা স্রোত। একদল কিশোর ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর ঠান্ডা জলে। আমি দাঁড়িয়ে নতুন রংমাখা কংক্রিটের ব্রিজের উপর। শরীরটা আজ মেজমেজ করছে। মনটা আকাশের মতো এতো ভালো নেই। হাতে ক্যামেরা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছি মাঝির ভেসে আসা নৌকা লক্ষ্য রেখে। ফ্রেম আর মুভমেন্ট মিলে গেলেই শাটার ক্লিকের শাট শাট শব্দ হবে। আর সুন্দর একটি ছবি বের করতে পারলেই মন নিমিষেই ভালো হয়ে যাবে। আমার জন্য এ আর নতুন কিছু নয়। মনভালো করার অনেকগুলো উপকরণের মধ্যে একটি উপকরণ হচ্ছে ক্যামেরা হাতে প্রকৃতির মাঝে ডুব দেওয়া। মাথার উপর দিয়ে আকাশে এক ঝাঁক সাদা বক উড়ে গেলো। ক্যামেরা তাক করতেই বকের দলটি বহুদূরে মিশে গেলো। পাশের বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসছে চড়ুইদের কিচির মিচির শব্দ। যেনো আমার মন ভালো করার আয়োজনে নেমেছে সব চড়ুই। কতো বৈচিত্রময় সুন্দর দৃশ্য প্রকৃতি আমাদের দু’নয়নে মেলে ধরে। তবে প্রকৃতির সবচেয়ে মহামূল্যবান দৃশ্যগুলো শুধু উপভোগ করা যায় তা আলোকযন্ত্রের পিক্সেলের কণায় স্থির রূপ দেওয়া যায় না।
দুই.
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা! মন খানিকটা ভালো!
সন্ধ্যার নীলিমা ঘিরে ধরেছে পুরো পৃথিবী যেনো আগুনে আঁকা বিশাল চিত্রকর্ম! ছোট বেলায় এই লাল-কমলা রঙের নীলিমাকে বলে বেড়াতাম প্রিয় নবীজির নাতি হাসান-হোসেনের রক্ত! আর্ট ক্যানভাসে এমন গোধূলী রঙের ছবি আঁকতে বেশ ভালোবাসি। মাঝে মাঝে ক্যামেরাকে ছুটি দিয়ে রং-তুলির সংমিশ্রণে বসি। মনকে ফুটিয়ে তুলি সাদা ক্যানভাসে। ই-জেলের আটকানো গোধূলির ছবি! কূল কিনারাহীন একলা মাঝি। খালি গলায় সুর ধরে ভেসে যাচ্ছে,ভয় নেই তাঁর, অকুতোভয়! আঁকার মাঝ পথেই রঙ শেষ! নদীর কিনারা দেবার রং নেই।
অসম্পূর্ণ কর্ম। দৌড় মেড়ে রঙ কিনবারও টাকা নেই! ফাঁকা পকেট,তবে একেবারেই ফাঁকা নয়!
১টা দশ টাকার কচকচে নতুন নোট প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করা আছে। শিল্পীদের পকেট এমনই। সব সময় শূন্য! শূন্য পকেটে চলতে পারাটাই যেনো শিল্পীদের এক ধরনের দারুণ শিল্প!
তিন.
সূর্য পূর্বে হেলে গিয়ে দুপুর শেষে বিকেল গড়ালো। এক দশক আগের কথা। দক্ষিণ চর্থা ইকবাল মিয়ার মেস থেকে প্রতিদিনের মতো টিউশনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম। পায়ে ৫০টাকা দরের একজোড়া সেন্ডেল। শিক্ষাবোর্ডের পেছনেই সরকারি কোয়ার্টার। সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী সড়ক। বৃষ্টি এলেই রাস্তাটিতে থৈ থৈ জল হাঁটুর উপর ভেসে উঠে। রাস্তার উত্তরপাশে প্রথম ভবনটিতেই ছাত্রের পরিবার থাকে। জিলা স্কুলের নবম শ্রেণীতে পড়তো। সালাউদ্দিন হোটেল যেতেই সেন্ডেল গুলো পা মচকে ছিঁড়ে গেলো। এই মাসের বেতন পেলেই জুতা কেনার পরিকল্পনা ছিল। ফাঁকা পকেট। হাতে ছেঁড়া জুতা নিয়ে হাঁটতেও কেমন লজ্জা লাগছে। লজ্জার মাথা খেয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। ক’দিন পরই কোরবানির ঈদ। ঈদের বন্ধ দিয়ে আজকে বেতন পাবো। কিছু কেনাকাটা করবো। বাবার জন্য পাঞ্জাবি,মা’র জন্য শাড়ি,আর আমার জন্য একজোড়া চামড়ার জুতা। দরজায় কলিং বেল টিপতেই চোখ পড়লো তালা দেওয়া দরজায়। মন যেনো আষাঢ়ে মেঘে ঢেকে গেলো! ছাত্রের মা কল দিয়ে জানালো তারা ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেছে, ঈদের পর এসে কল দেবে! এ শুধু আমার নয়,মেসের টিউশন করা প্রতিটি ছাত্রের অভিজ্ঞতার গল্প!
চার.
লিখতে বসলেই চলে আসে নক্ষত্র,মানুষের যাপিত জীবন,এক ঝুড়ি দুঃখ-কষ্ট-বিরহ! মানুষের দুঃখ থাকবে,কষ্ট থাকবে,যন্ত্রণা থাকবে তাই স্বাভাবিক। অমানুষের কবজায় সুখ বন্দি থাকাটাও অস্বাভাবিকের কিছু নয়। তবে প্রশ্ন থাকে জীবনে তৃপ্তি কার বেশি-মানুষ নাকি অমানুষের?
কলম নিয়ে এসব আজগুবী ভাবতে ভাবতে নক্ষত্ররা তখন ঘুমিয়ে পড়ে। চাঁদের কলঙ্ক তখন ধুয়ে মুছে ছাফ করে দেয় জোছনার রঙ। যে রঙ ধনী-গরিব সকল মনকে স্নিগ্ধতায় অসম ডুবিয়ে নেয়! ফকফকা উঠান! চারদিকে গোলাভরা ধানের গন্ধ। কুনো ব্যাঙ্গের ক্র্যাক ক্র্যাক শব্দ। আর অসহায় মানুষের চোখের জল কলমের আগায় টুপটুপ বেয়ে পড়ে নোনা অক্ষর! টাউনহলের মাঠ। পথশিশুদের ঘাসের উপর পড়ে থাকা অবহেলিত দেহ। তাদের স্বপ্ন! বই-খাতা,পড়ালেখা,ওদের স্কুল! এসব ভাবতেই রাত শেষ হয়ে যায়,চোখে ঘুম নেই,পকেটে অর্থ নেই। দু’চরণ না লিখলে যেনো মস্তিষ্কের কোষ অস্থিরতায় আরো উত্তাল হবে। কেরসিনে জ্বলা হ্যারিকের আবছা আলো। জানালার পাশে জোনাকিদের খেলা,এসব শুধু উপভোগই করা যায়। কলমের কালিতে সম্পূর্ণ বর্ণনা অসম্পূর্ণই থাকে। মাঠের পর মাঠ কবি ফাঁকা পকেটে হাঁটতে থাকে,ভাবতেই থাকে,তবুও জীবনের কবিতা তাঁর অসম্পূর্ণই থাকে!
সংসার আছে,ঘর আছে,বউ আছে,ফুটফুটে এক কন্যা আছে! তবুও অসম্পূর্ণ! কি যেনো নেই-অস্পষ্ট অক্ষর,টলমলে কিছু চোখ,একমুঠো নিরবতা!
পাঁচ
একটা গোলাপের বাগান করার ইচ্ছে ছিলো। সকল বাধা বিপত্তি উপড়ে ফেলে সেই বাগানটা করা হলো। বাগানে এখন অনেক গোলাপ। ছোট-বড় প্রায় ৭০টি গোলাপ রয়েছে! বাগানটার নামকরণ করেছি “মানুষ”। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই এই গোলাপবাগানের এক একটি লাল মোহিত ফুল! ডাস্টবিন না হয়ে এরা সমাজ-রাষ্ট্রে,মানুষের ধারে ধারে একদিন সুগন্ধ ছড়াবে। ২০১৩সালের ২০সেপ্টেম্বর এই গোলাপ বাগানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম এই প্রতিষ্ঠানের সাথে মিশ্রিত! বাবা বলতেন-মানুষ,সমাজ,দেশকে যতোটুকু পারো দিয়ে যাবে। কারো থেকে কিছু পাওয়ার আশা করবেনা। সবসময় মানুষ বা সমাজের কল্যাণে এগিয়ে থাকবে। কখনো কাউকে কষ্ট দিবেনা। হাসি মুখে মানুষের সবটুকু বরণ করে নেবে।
জীবনে গৌরব করে চলবেনা। অহংকার নিজেকে ছোট করবে,ধ্বংসের মুখে পতিত করবে। সততায় জীবন সঞ্চালন করবে।
সৎ পথে থেকে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার তৃপ্তি অসীম। অসৎ পথের ধনবান হওয়ায় ক্ষীণ ছাড়া কোনো তৃপ্তি নেই। অট্টালিকার পেছনে দৌড়ে কি হবে,যদি না সেখানে তৃপ্তি,সুখ থাকে। যে সুখ খুঁজে নিতে পারে,সে ভাঙা চৌচালা টিনের ঘরেও পারে। মাও ঠিক তাই বলেন। সকলের দোয়া এবং মা-বাবার সাধু বাণী নিয়ে জীবন টেনে নিচ্ছি। জানিনা গোলাপের সুগন্ধ ছড়াতে আর কতোদূর? মহাপর্যবেক্ষণ করে দেখেছি-জীবন অসম্পূর্ণতেই যেনো বিশদ সুন্দর,অতি দরিদ্রতেই যেনো বেশ সমৃদ্ধ,ক্ষুদ্র হলেও যেনো চির মহান! পরম তৃপ্তিকর!
ছয়
কতোদিন রাত জাগা হয় না! ইচ্ছে করলেও পারিনা।
হুমায়ূন আহমেদ পড়তে পড়তে এক সময় হিমু হওয়ার খুব বাসনা ছিলো। কয়েকটা কুকুর সাথে করে সারা শহর হেঁটে বেড়াবো। রূপার মতো হালকা-পাতলা ধরনের কোন এক রমনী নীল শাড়ি জড়িয়ে আমার হাত ধরবে। কাঁধে মাথা রেখে বাদল দিনের গান শুনাবে। অবশ্য বহুরাত একলা হেঁটে বেড়িয়েছি। রূপার মতো কোনো রমনী হাত ছুঁতে আসেনি। পরিশেষে হিমু হওয়ার ইচ্ছেটুকু অসম্পূর্ণই থেকে গেলো!
উপভোগ করার মতো সবচেয়ে প্রিয়- নির্ঘুম রাত! লালন সঙ্গীত বাজিয়ে আকাশ দেখা। বাবা মারা যাওয়ার পর অবশ্য তাও এখন আর হয়ে উঠেনা। মা-বোন,বউ-সন্তান মাথায় বেশ ভর করেছে। ভাবনার সিংহ অংশ তাদের জন্যই ব্যয় করতে হয়। এখন আয় করতে হয়! নিজেকে দ্বায়িত্ববান বানাতে হয়। কখনো ছেলে,কখনো ভাই,কখনো স্বামী,কখনো বাবা,কখনো অসহায় মানুষের ছায়া!
ঈদ গাহের পথ, পার্ক স্ট্রিটের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে জীবনের সমীকরণ খুঁজি! অসম্পূর্ণ জীবন! রফিক মিয়ার টং দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে দেখি-জীবন কতোটা স্বাদহীন! আবার কতোটা আকর্ষণ! এইভাবেই মেনে নিতে হয়। অসম্পূর্ণ-তবুওতো জীবন!

লেখক: ফটোগ্রাফার ও শিক্ষা সংগঠক।