বৃক্ষ নিয়ে বাড়াবাড়ি!— ডা. আবু নাইম

 

আমি গুছিয়ে লেখতে জানিনা। তবে অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে জানি বিলক্ষণ। ঈদের লেখা চেয়েছেন শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই। উনাকে মানা করার চেয়ে কঠিন কাজ আর কিছু নেই। তাই এই অপাঠ্য লেখার প্রয়াস। পাঠকগণ নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
উদ্ভিদ, গুল্ম, বৃক্ষ,মহীরুহ সবার প্রাণ আছে।

প্রাণ থাকলেও নেই উন্নত গুরু মস্তিষ্ক। তাই ওদের সুখ দুঃখের কথা জানাতে পারেনা ওরা। যদিও গাছেরা ব্যাথায় কাতর হয়, ক্ষুধা তৃষ্ণা পেলে এমন শব্দে চিৎকার করে যা মানুষের শ্রবণক্ষমতার বাইরে। পাশাপাশি থাকা গাছেরা শিকড় দিয়ে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে। তথ্যের আদান প্রদান করে, খোঁজ খবর নেয়। আবার এমনো দেখা গেছে একটা বনের এক প্রান্তে গাছ কাটা হলে অন্য দূরে থাকা গাছেরাও ভবিষ্যৎ বিপদের আভাস টের পেয়ে যায় শিকড়ের মাধ্যমে। বিষক্রিয়ায়,অসুখে, দুঃখে কাতর হয় গাছেরাও। গাছেদের এই সবুজ জগতেও খাদ্য, পানি নিয়ে চলে ভীষণ প্রতিযোগিতা।
দেখা যায় বড় গাছের গোড়ায় সহজে ঘাস বা ছোট গাছ জন্মে না। তার একটা প্রধান কারণ হলো বড় গাছ থেকে নিঃসরণ করা কিছু রাসায়নিক পদার্থ যা ছোট গাছকে মেরে ফেলে বা জন্মাতেই দেয় না। কারণ হলো, ছোট গাছ যেনো বড় গাছের খাবার, জলে ভাগ না বসাতে পারে।
নিজের নিরাপত্তার জন্য গাছেরা পাতাকে কাঁটায় রুপান্তরিত করে। ফুলে, কচি ডগায়, বীজে বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। কাঁটার জন্য সহজে কেউ হাত বাড়াবেনা, ডাল কাঁটবেনা। বিষাক্ততার জন্য সহজে খাদ্যে পরিণত হবেনা গাছ। যেমন আম গাছে মুকুল আসলে আম পাতা, লাকড়ি পুড়িয়ে রান্না করাও সমীচীন না। কারণ এতে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি ধোঁয়ার সাথে মিশে মানুষকে অসুস্থ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। গাছের প্রাণ আছে একথা সুস্পষ্ট এখন।
যদিও প্রাণশক্তিতে আদিপ্রাণ গাছেরা অনেক ক্ষমতাসীন তবুও গাছ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষের পরাক্রমের কাছে নতজানু হয়ে রয় । বৃক্ষের বেঁচে থাকায়, বংশবৃদ্ধি করায় আমাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। উন্নয়ন স্থাপনা, সড়ক প্রসারণ, কাঠ সংগ্রহর জন্য নির্বিচার বৃক্ষ কেটে ফেলছি আমরা। একটা শতবর্ষ পুরনো গাছে অনেক প্রজাতির ছোট – বড় পাখি, পোকামাকড়, পরজীবী গাছের বসবাস থাকে। পুরনো গাছ কেটে ফেলা মানেই সাথে সাথে এদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।
মানুষের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই বৃক্ষ তথা বন সংরক্ষণ, বৃক্ষ রোপণ প্রয়োজন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হচ্ছে ধীরে অথচ প্রতিনিয়ত। গ্রিন হাউজ ইফেক্টের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে আমাদের ঠিকানা হবে লোনা পানির জল। অথচ আমরা তা ঠেকাতে কি করছি? সব কাজের দায়িত্ব সরকার বা রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়াই কি শেষ কথা? আমাদের নিজেদের দায়িত্ব নেই বা কিছু কি করার নেই?
সে চিন্তা থেকেই আমি কুমিল্লায় একটা প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাই যার নাম কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটি ।
শুরু থেকেই আমার একটা উদ্দেশ্য ছিলো এবং আছে- বিনামূল্যে সবুজ বিতরণ। কারণ বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সামগ্রি, ঔষধ, শিক্ষা সব কিছুই আমাদের কিনে নিতে হয় এমনকি স্থানভেদে পানিটুকুও কিনে নিতে হয়। বেঁচে থাকার মৌলিক বস্তু অক্সিজেনটাই আমরা বিনামূল্যে পাই। যার সবটুকু দিচ্ছে চারপাশে থাকা সবুজের দল। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সিদ্ধান্ত নিলাম বিনামূল্যে বীজ, কাটিং, চারা, গাছ দিব। আমার একার পক্ষে তো আর সম্ভব না এত কিছু করা। তাই এ মন্ত্রে উজ্জীবিত করলাম আমার সাথে যাঁরা এই প্ল্যাটফর্মে যোগ দিলেন তাঁদের সবাইকে। এগিয়ে আসলেন অনেকে। যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলাম ফেসবুকটাকেই।
যার বাগানে যা অতিরিক্ত বীজ, চারা, গাছ হয় তা নিয়ে দু তিন মাস পর পর আমরা একত্রিত হই। যার যা প্রয়োজন তা সে নিয়ে যায়। নিজেদের মাঝে অদল বদল আর উপহার বিনিময়ের এই ধারায় যোগ দিতে এখন সদস্য সংখ্যা সাতাশ হাজার। জেলা কুমিল্লার সকল উপজেলার এমনকি বাইরের জেলা থেকেও অনেকে আসেন গাছের টানে। গাছ নিয়ে যাবার সময় আমি একটাই অনুরোধ রাখি, যেন বাড়লে পরেরবার সে গাছের বীজ, কাটিং, চারা উপহার দিতে আবার নিয়ে আসেন। একে বলা যায় বিনামূল্যে গাছ আদান – প্রদানের চক্র।
গাছ নিয়ে বাড়াবাড়ির শেষ নেই আমার এই প্ল্যাটফর্মের সবার। কারোই আগ্রহের কম নেই। ভালোবাসার কম নেই।
আমার কাছে তাই মনে হয় সরকারি নার্সারিতে বিনামূল্যে গাছ দেয়া গেলে অনেক নতুন বাগানির সৃজন হবে দেশে। দেশে সবুজের পরিমাণ টাও বাড়বে। অবশ্য প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকে। অনেকেই বিনামূল্যে পাওয়া কোন কিছুর মূল্যায়ন করতে জানেন না। দেখা গেলো, বিনামূল্যে গাছ নিয়ে কেউবা সেসব গাছ অল্প কিছু টাকার লোভে বিকিয়ে দিচ্ছেন। যুগে যুগে ভালো কাজগুলো হোঁচট খায় কিছু পথভ্রষ্ট সুযোগসন্ধানীদের কাছে।
দুঃখ বা নেগেটিভ দিক নিয়ে যত কম ভাবা যায় তত ভালো। গাছ নিয়ে আনন্দের কাহিনীর শেষ নেই আমার। রাস্তায় গাছ নিয়ে বের হলে সবাই প্রশ্ন করে জেরবার করেন , কি গাছ তা জানতে চান। সবার আগ্রহ ফল গাছে। যখনই শুনেন ফুল তখন বিমর্ষ হয়ে যান সবাই। এই যে আগ্রহ এখানেই আমার ভালো লাগা।
অনেকেই ভাবেন গাছ কি বিনামূল্যে দেয়ার জিনিস? দেশে ছাদকৃষি খুব জনপ্রিয় বিশেষ টিভি শো এর বরাতে। ছাদকৃষি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তবে ছাদকৃষি করে ক’জনের পরিবারের যাবতীয় শাকসবজি, ফলের চাহিদা মিটে খাদ্যের তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
শুধু খাদ্য পেলেই কি হবে? প্রশ্বাসে অক্সিজেন লাগবেনা? তার জন্যই গাছ দরকার। ফলদ গাছ ফুল, সৌন্দর্য বর্ধক, ঔষধি, ছায়ার জন্য ছায়াবৃক্ষ, বনের সু উচ্চ মহীরুহ। সবার প্রয়োজন আছে। আর আমি এ কথাটুকু জানাতে।
নিজে বাগান করার চেয়ে অন্যদের বাগানের প্রতি, বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে যেতে চাই আমৃত্যু।
সবুজেই যেনো থাকি, সবুজেই যেনো বাঁচি।
লেখক: প্রভাষক,কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।