বাঁশ-বেতের সাথে ৮০ বছরের সংসার

ইলিয়াস হোসাইন।।
মনির এবং মোস্তফা। একজন বাঁশ ছাঁচছেন আরেকজন বেতের কাজ করছেন। পাশে ওড়া(ঝুড়ি) প্রস্তুত করছেন তাদের স্ত্রীরাও। এই দৃশ্য কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ৪নং খোশবাস দঃ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের। তাদের পরিবার ৮০ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত। ধানমাড়াই থেকে চাল, শাক-সবজি ধোঁয়া,ভাতের পাতিল রাখা মাছা,হাটের লাই,জুইন,মাছের লাই,মাছের আনতা,মাছের ওঁছা,মুড়ির টুরিসহ গৃহকর্মে ব্যবহার করা হয় বাঁশের তৈরি হরেক রকমের সরঞ্জাম। কিন্তু বাঁশ শিল্পের এরূপ শৈল্পিক চিত্র এখন তেমন আর দেখা যায় না। বাঁশ-বেতের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্র।

সরেজমিনে দেখা যায়, বরুড়া উপজেলার ৪নং খোশবাস দঃ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের দুই দম্পত্তি আপন মনে বেতের কাজ করে যাচ্ছেন। প্রস্তুত করছেন বাঁশের গৃহ উপকরণ। দাদা লাল মিয়া কাজ করেছেন ৫০বছর। বাবা নিযুক্ত ছিলেন ২০বছর।এ দুই দম্পত্তি পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখে দেড় দশক ধরে।
সূত্র জানায়,এই শিল্প তৈরিতে তারা মুলি আর বরাক বাঁশকেই উপযুক্ত হিসেবে বেছে নেন। ওড়া,হাঁস- মুরগির খাঁচা,হাতপাখা,চাল চালুনি,ধুচা চালুন,কুলা,বর্ষা মৌসুমে মাছের আনতার চাহিদা বেশি থাকে। মাছের ডুলা,পাতলা(বৃষ্টির সময় কৃষক মাথায় দেন),ঝুমড়া,হাটের লাই,মাছের লাই,মাছের ছাই,মাছের ওঁছা(ছোট মাছ ধরার পণ্য) চাহিদা না থাকায় গৃহসরঞ্জাম থেকে এগুলো হারাতে বসেছে। আলু তোলার মৌসুমে চাষীদের ওড়ার চাহিদাটা একটু বেশিই থাকে।

মো. মনির হোসেন বলেন ‘ ১৫বছর ধইরা কাজ করতাছি। উপজেলার থেইক্কা একটা প্রশিক্ষণও নিছি। অন্যজনের কাম করতে মন চায় না। এইঢা আমগো নিজের কাম। নিজের কামে স্বাধীনতা আছে,আনন্দ আছে। যহন ইচ্ছা তহন নিজের কাম করন যায়। পাশা-পাশি খেত -খামারসহ বউ-ঝিগোরে দেহন যায়। আমার স্ত্রীকেও এই কাজ শিখাইছি।’

মনিরের স্ত্রী শাহিনুর বলেন,‘এই কাজ কইরাই নিজেদের মাথা রাহনের একখান ভিটা জোড়াইছি,সন্তানগোরে স্কুলে পাঠাইতাছি,তাগো পড়া-লেহার খরচ মিটাইতাছি। বড় মাইয়া খাদিজা সিক্সে পড়ে,ছুডু মাইয়া টু’এ। আমি আগে গার্মেন্টসে কাম করতাম এহন শুধু বাঁশ দিয়া বিভিন্ন জিনিস বানানের কামই করি।’

মো. মোস্তফা জানান, আমি দৈনিক ৭-৮টি ওড়া বানাতে পারি। সপ্তাহে বানানো যায় (তাদের কর্মদিবস ৬দিন) ৪৫-৫০টি ঝুড়ি। আমাদের গ্রামের উত্তর পাশে ফকিরা বাজার হাটে এগুলো নিয়ে যাই। আবার কিছু লোক বাড়ি থেকে কিনে নেয়। দৈনিক বিক্রি করতে পারি ৮’শ -৯’শ। কোন কোন সময় ১হাজার টাকা। এর থেকে ৬’শ-৭’শ টাকা লাভ থাকে। মাসে ১২-১৫হাজার টাকা উপার্জন হয়। আমি ও আমার স্ত্রী জেসমিন মিলেই এই কাজ করে থাকি। উপজেলাতে প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করে রেখেছি। যখন ডাকবে তখনই করবো। এই কাজের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তিনি বলেন-নিজের কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এতে কোনরকম জবাবদিহিতা নেই। মুক্ত মনে কাজ করা যায়। পাশাপাশি কৃষিতে সময় দেওয়া যায়। বিপদ-আপদেও পরিবারের পাশে থাকা যায়। কেহ চাইলে বেকারত্বের ভার না নিয়ে কাজ শিখে এ পেশায় নিজেকে অল্পপুঁজিতে নিয়োজিত করতে পারে। এ পেশায় যতোটা সুবিধা পাওয়া যায় বিদেশ গেলেও কেউ এতো সুযোগ পাবেনা।

 

 

আর অসুবিধা বলতে- কাঁধে ভার করে নিয়ে ময়াল করা সম্ভব হয়না। অন্যের ভ্যান ভাড়া করে নিলেও পোষায় না। যদি মোটরযুক্ত আমাদের নিজের ভ্যান হতো তাহলে অনেকগুলো গ্রাম ফেরি করার সুযোগ পেতাম। আমাদের ব্যবসা আরো সমৃদ্ধ হতো এবং আমাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকে থাকত।

 

একই গ্রামের বাসিন্দা কোরিয়ান প্রবাসী মো. শাহজাহান বলেন,আমার বাবা কৃষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখতাম কৃষির পাশাপাশি বাবা বাঁশের বেত বুনে অনেক সরঞ্জামাদি তৈরি করতেন। কিছু বিক্রি করতেন আবার নিজের কৃষি কাজের প্রয়োজনও মিটাতেন। বাবা পরলোকগমনের পর তা বন্ধ। এই গ্রামে অনেকেই পেশাভিত্তিক, শৌখিন,বা গৃহপ্রয়োজন মেটাতে এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। কিন্তু এখন আর তেমন সচারাচর দেখা যায় না। সবাই অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। গ্রামে এই দুই দম্পত্তিকেই ইদানিং আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়।

 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন সমাজ কর্মী মো.আব্দুর রহমান রতন বলেন, মনির ও মোস্তফা দম্পত্তির এই বাঁশের কাজ আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অংশ। যা আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। তাদের কাজের মান যেন বাড়ে সে উদ্দেশ্যে ওদের উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অধীনে “প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পে” প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেই। তাদের মধ্যে মনির হোসেন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর মোস্তফা আবেদন করে রেখেছেন। তাদের স্ত্রীদেরও এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনার চেষ্টা আছে। প্রশিক্ষণের ৬মাস পর তাদের প্রত্যেককে এককালিন ১৮হাজার টাকা প্রদান করা হবে।