বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের সুদিনের প্রত্যাশা

কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের খ্যাতি বাংলাদেশ জুড়ে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে এখানকার উৎপাদিত পণ্য। পূর্বে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকলেও বর্তমানে তা সমিতি কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সমিতিকে ব্যাপক আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। অপরদিকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে না পারা ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাবে ক্রমশ কমতে শুরু করেছে গ্রামীণ পর্যায়ের মৃৎশিল্পীর সংখ্যা। এনিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।

সংবাদে উল্লেখ করা হয়,প্রায় ২০০ বছর পূর্বে ফেনী জেলার খন্ডল নামক স্থান থেকে কুমিল্লার বিজয়পুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলেন হিন্দু পাল সম্প্রদায়। তাছাড়াও বৃহত্তর কুমিল্লার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাল বংশের লোকেরা বিজয়পুর ও বারোপাড়া ইউনিয়নে স্থায়ী হন। এক সময় দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করা হতো। বিজয়পুর এলাকায় পাল বংশের লোকজন স্থায়ী হবার পর সেখান থেকে ব্যাপক পরিসরে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের উৎপাদন শুরু হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে পরিচিতি লাভ করে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প। দেশের সব জেলা থেকে ব্যাপারীরা ও ব্যবসায়ীরা এসে বিজয়পুরে উৎপাদিত মাটির পণ্য নিয়ে যেতেন। মানে ভালো ও টেকসই হওয়ায় এর কদর ছিল বেশ। স্বাধীনতার পূর্ববতী সময় থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিদেশে রপ্তানিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ছিল বেশি। এসময়ে বর্তমান বিজয়পুর উত্তর, বিজয়পুর দক্ষিণ ও বারোপাড়া ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের আট শতাধিক পরিবার নিজেদের সম্পৃক্ত করেন মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বিজয়পুরের মৃৎশিল্পকে আরও বিস্তৃত করতে পরিকল্পনা হাতে নেন বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ ও কুমিল্লা পদ্ধতির জনক ড. আখতার হামিদ খান। তার অনুপ্রেরণা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল বিজয়পুরের প্রগতি সংঘ নামের যুব সংগঠনকে রূপান্তরিত করে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি নামকরণ করা হয়। ১৯৬২ সালের ৮ আগস্ট তা সমবায় সমিতির নিবন্ধন লাভ করে। গ্রামে ও সমিতিতে সমানতালে উৎপাদন হতে থাকে মৃৎশিল্পের। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এসময় হুমকিতে পড়ে যায় বিজয়পুরের মৃৎশিল্প। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কুমিল্লায় আসেন, তখন এ শিল্পের ভগ্নদশা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন সমিতির লোকজন। বঙ্গবন্ধু তাদের ৭৫ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সমিতিকে। অপরদিকে গ্রামীণ পর্যায়ের মৃৎশিল্পীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে উৎপাদনে যেতে হিমশিম খান তারা।

স্বাধীনতার পর জমি বিক্রি করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন তেগুরিয়াপাড়া, গাঙকুল, দক্ষিণ বিজয়পুর, উত্তর বিজয়পুর, বারোপাড়া ও নোয়াপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। সদর দক্ষিণ উপজেলাটি আয়তনে বড়, লালমাই পাহাড় ঘেঁষা ও কম জনবহুল হওয়াতে গোড়াপত্তনের দিকে কম দামে বেশি জায়গার মালিক হন পাল সম্প্রদায়ের লোকজন। সংকট কাটাতে এ জায়গাগুলো ধীরে ধীরে বিক্রি শুরু করেন তারা। জায়গা বিক্রির এক পর্যায়ে নি:স্ব হয়ে পড়েন অনেকে। এমনকি আদিম ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ভূমিহীন হয়ে পড়েন কেউ কেউ। বর্তমানে মৃৎশিল্পীদের ৭০ জন ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন।

এছাড়া সমন্বয়হীনতা, বর্তমান সময়ে ব্যাপক চাহিদা থাকা মাটির তৈরি পণ্য করতে না পারা, মান্ধাতার আমলের উৎপাদন ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব, ন্যায্যমল্যূ না পাওয়া , মাটি ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় প্রচার-প্রসারের অভাব, মৃৎশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য পরিবেশসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় মার খেয়েছেন এখানকার মৃশিল্পীরা। বর্তমানে পাল সম্প্রদায়ের মাত্র ১০০টি পরিবার যুক্ত আছেন এ পেশায়। যাদের গড় আয় মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।

গাঙকুল গ্রামের রবীন্দ্র পাল ৪০ বছর ধরে তৈরি করেন মাটির তৈরি পণ্য। এ মৃৎশিল্পী জানান,‘ আগে তৈজসপত্র ছাড়াও হাতি-ঘোড়া ও বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি বানিয়ে বিক্রি করতাম। মাটি ও লাকড়ি পেয়ে যেতাম বিনামূল্যে। কাউকে কিছু বানিয়ে দিলে তারা স্বেচ্ছায় মাটি ও লাকড়ি দান করতেন। এখন মাটির দাম ঊর্ধ্বমুখী, বিক্রিও কমে গেছে। তাই মাঝেমাঝে পণ্য বানাই, মাঝেমাঝে অন্য কাজ করি।’

মৃৎশিল্পের এক সময়কার বড় ব্যবসায়ী রাজ মোহন পাল। তার অধীনে কর্মরত ছিল ২৫০ জন মৃৎশিল্পী। তিনি জানান,‘ মৃৎশিল্পীদের সময় খারাপ এ কথা সত্যি। তারপরও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মৃৎশিল্পীদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের খ্যাতি বাংলাদেশ জুড়ে। আমরা মনে করি, এই শিল্প ও তার সাথে জড়িত কারিগরদের রক্ষায় প্রশাসনকে ভূমিকা নিতে হবে। পরিবেশ বান্ধব এই শিল্প বেঁচে থাক সেটি সবার কাম্য।