ময়মনসিংহে সবুজের মুগ্ধতা

|| মহিউদ্দিন আকাশ ।।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের তুলনায় সংবাদ কর্মীদের ব্যস্ততা নেহাৎ কম নয়। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পরপরই ভ্রমণের সিদ্ধান্ত, কারণ একটু প্রশান্তি দরকার।
কেউ বলল কক্সবাজার কেউ সুন্দরবন আবার কেউ কেউ ময়মনসিংহ যেতে চাইলেন। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই বললেন- শিক্ষা আর আনন্দ যেখানে সেখানেই ভ্রমণ।
যেই কথা সেই কাজ মিনিট কয়েকের মাঝে সিদ্ধান্ত ১৭ জানুয়ারি আমরা যাব উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল কবি নজরুলের স্মৃতিময় সব প্রতিষ্ঠানসহ ঐতিহ্যবাহী সব পর্যটন এলাকায়। যদিও পরে মোল্লা ভাইয়ের মুখে শুনেছি-এর উদ্যোক্তার আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বী ভাই ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কুমিল্লা প্রতিনিধি তৈয়বুর রহমান সোহেল ভাই। যদিও তারা শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি।
শৈত্য প্রবাহে যখন কুমিল্লা কুয়াশাচ্ছন্ন তখন আমরা শীতে জবুথবু হয়ে বের হলাম কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্য।
কথায় আছে, ৯ টার টা ১০ টায় ছাড়ে। সেদিন তাই হল ১১ টার ট্রেন আসল ১২ টায়। ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠতে গিয়ে মোহাম্মদ শরীফ হারালেন তার প্রিয় স্মার্ট ফোন।
ভ্রমণের শুরুতেই এ দুর্ঘটনা খানিক মন খারাপ করলেও মোহাম্মদ শরীফের ধৈর্য্য দেখে আনন্দ ফিরে এল।
ঝক ঝকা ঝক ট্রেন চলছে আর আমরা সুরে বেসুরে গান ধরছি। কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…।
প্রায় ৬ ঘন্টা জার্নি শেষে থেমে গেল ট্রেনের গতি । ময়মনসিংহ শহরে এসে অটোরিকশা করে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট(বিনা) গেস্ট হাউজে উঠে সবাই বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
বিনা কুমিল্লার অফিস প্রধান কৃষিবিদ ড.মো. আশিকুর রহমানের সার্বিক সহযোগিতায় শুরু হলো আমাদের ভ্রমণ। রাতের খাবার শেষে আমরা বের হলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। রাজধানীর বাইরে এত চমৎকার  বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আছে তা আমাদের অনেকেরই অজানা।
পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত জব্বারের মোড় থেকে আমরা রওয়ানা হলাম ত্রিশালের উদ্দেশ্যে।
সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শৈশবের কিছুদিন কেটেছে। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ নজরুলের নামে নানান প্রতিষ্ঠান।
ত্রিশাল বাজারের দরিয়ারামপুর হাইস্কুলে পড়াশোনা করতেন কাজী নজরুল ইসলাম আর থাকতেন খানিকটা দূরে নামাপাড়া গ্রামে।
তবে সেই দরিয়ারামপুর হাইস্কুল এখন ত্রিশাল সরকারি নজরুল একাডেমি নামে পরিচিত।  সেখানের শিক্ষার্থীরা গর্ববোধ করেন নজরুল এ স্কুলে পড়েছেন বলে।
সেখান থেকে কিছু পথ গেলে বিশাল আকৃতির একটি বটগাছের দেখা মিলে।  তারপাশেই কবি নজরুলের বাবা মায়ের ডাকা আদুরে নাম দুঃখু মিয়া একাডেমি।
‘ প্রচলন রয়েছে- স্কুল পালিয়ে নজরুল প্রায়ই এ বটগাছের ডালে বসে বাঁশি বাজাতেন, গান গাইতেন,কবিতা, ছড়া লিখতেন।
বটগাছ থেকে কিছুদূর গেলেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাকৃতিক অপরুপ পরিবেশে গড়ে উঠা এ ক্যাম্পাসজুড়ে নজরুল।
একাডেমিক ভবনের পাশের ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে কবির যুবক বয়সের রুপ। একটু সামনে গেলেই “চির উন্নত মম শির’ কবিতাংশ লিখা মুক্ত মঞ্চ।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের যানবাহন ভ্যানে করে আমরা চললাম কবির লজিং বাড়িতে।
সেখানে নজরুল জাদুঘর এবং নজরুল ইন্সটিটিউট রয়েছে। এ দুই প্রতিষ্ঠানের সামনের পুকুরে গোসল করতেন কাজী নজরুল ইসলাম। থাকতেন পুকুরের পাড়ের ঘরটিতেই।
জাদুঘরে কবির বিভিন্ন বয়সের পেশার এবং অনেক স্মৃতি ফ্রেমে বন্দি করে ঝুলানো রয়েছে।
এমন সুন্দর দৃশ্য আর ঐতিহ্য দেখা সহজ হয়েছিল কুমিল্লার ছেলে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জামাল ও অনিকের সঙ্গ পাওয়ার কারণে।
আমাদের টিমের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আব্দুল্লাহ আল মারুফের খুব ইচ্ছে মুক্তাগাছার ঐতিহ্য ‘মন্ডা’ খাবে।
 আমাদের যাত্রা মুক্তাগাছার উদ্দেশ্যে।  রাস্তার অবস্থা খুবই বাজে।
তবে মুক্তাগাছা গিয়ে মন ভাল হয়ে গেল। নানান ঐতিহ্যে ভরপুর মুক্তাগাছা উপজেলা।  ২০০ বছরের পুরনো মন্ডা নামে চললেও স্বাদে তেমন নয়। একটা মন্ডা কোনরকম খেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে মারুফ ইতিমধ্যে ৩টা খেয়ে ফেলছে।
আমি ও ঢাকা ট্রিবিউনের মহসীন কবির ভাই মণ্ডায় সন্তোষ ছিলাম না।
আমাদের সাথে  হয়ত হেঁটে না পেরে ইলিয়াস ,অমিত,শরীফ পিছনে পড়ে যান। সে সুযোগে তারা পুরনো এক মন্দিরে ঘুরে আসে।
আমরা চললাম জমিদার বাড়িতে। আচার্য চৌধুরীর সে বাড়িখানা এখন আট-আনী জমিদার বাড়ি বা মুক্তাগাছার রাজবাড়ী হিসেবে পরিচিত।
জমিদাররা এখন নেই তবে তাদের তৈরি দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যের সে স্থাপনাগুলো রয়ে গেছে।

সেখানে গিয়ে জানা যায়,রাজার বাড়িতে যারা কাজ করত তারা প্রতিদিন গোসল করে তারপর ভিতরে প্রবেশ করতে হতো।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমরা ফিরলাম গেস্টহাউজে। ফ্রেশ হতে হতে বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কল দিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের বায়োফার্মার ইনচার্জ কুমিল্লার লাকসামের জসিম ভাই। তিনি সকল ব্যস্ততার মধ্য দিয়েও আমাদের জন্য জব্বারের মোড়ে অপেক্ষা করছেন। নিউজের ব্যস্ততার কারণে মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই বের হতে না পারলেও আমরা সবাই জসিম ভাইয়ের আথিতেয়তায় মুগ্ধ হলাম।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন,ভাস্কর্য এবং দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যপটে ঘুরালেন। শীতের রাতে নিরব নিস্তব্ধ ভার্সিটি ঘুরে আমরা রেললাইনে হাত ধরে ধরে গেস্ট হাউজে ফিরলাম।
খুব সকাল সকাল আমরা বের হলাম। জব্বারের মোড়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব, বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সেক্রেটারি আতিক।
দুজনই সারাদিনভর আমাদের সময় দিলেন। প্রথমে আমরা গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে। দেখতে মনে হবে মিনি সুন্দরবন। ঔষধি নানানগাছে সমৃদ্ধ এ গার্ডেনে গেলে শতবেদনা ভুলে মন হবে ফুরফুরে।
মেয়েদের হলের পাশেই ব্রহ্মপুত্র নদের নৌঘাঁট। হিমেল হাওয়া আর শান্ত পরিবেশের এ ঘাট যেন কবির কবিতার মত।  প্রেয়সীকে নিয়ে জনম জনম হারিয়ে যাওয়ার গান গাওয়ার
(মহিউদ্দিন আকাশ)
উপযুক্ত পরিবেশ।
নৌকায় উঠে সবাই যেন গায়ক হয়ে উঠল। সমস্বরে গানে মনে হল আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।  সবার রিকোয়েস্ট একক ভাবে গান ধরলেন মহসিন কবির ভাই। তোমার হাত পাখার বাতাসে ….।
নদীতে থাকা অবস্থায় মুয়াজ্জিনের সুমধুর ডাক – হাইয়্যা আলা সালাহ- হাইয়্যা আলাল ফালাহ শুনে বাকৃবির কেন্দ্রীয় মসজিদ নামাজ আদায়ের আগেই আমরা টিএএসি তে খাবার খেলাম। দামে কম মানে ভাল কথাটি এখানের জন্য উপযুক্ত।
প্রায় ১২০০ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভিন্ন অনুষদ ভবন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, অডিটোরিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেন, হর্টিকালচার মাঠ, স্টেডিয়াম, জিমনেসিয়াম, জিটিআই ভবন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র সব দেখার সুযোগ না পেলেও হর্টিকালচার মাঠের বিশালতায় মন ভরেছে।
সারি সারি আম গাছের বিশাল সড়ক। পাশে সরিষা বাগান। এ যেন বাংলার  যৌবনের রুপ।
একাডেমিক ব্যস্ততার কারণে আমাদের সময় দিতে পারেননি বলে আক্ষেপ কুমিল্লার গর্ব বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড.আহমেদ খায়রুল হাসান স্যারের। শহরের সবচেয়ে ভাল রেস্টুরেন্টে আমাদের নিয়ে তিনি ডিনার করলেন। কথা হল কুমিল্লার রাজনীতি, শিক্ষাসহ নানান বিষয়ে। কুমিল্লার ছেলে আলো ছড়াচ্ছেন দেশজুড়ে। সেই আলোচনায়ও ড.মো. আশিকুর রহমান হাজির। তার বিনয়,কর্ম দক্ষতা আর নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা।
বিদায় জানাতে রেলওয়ে স্টেশনে আসলেন জসিম ভাই। এবার যথাসময়ে ই আসল ট্রেন।  আমরা চললাম কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। ফের গান আর গল্পে কখন যে কুমিল্লা চলে আসলাম টেরই পাইনি।
লেখক:সেক্রেটারি,রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম,কুমিল্লা।