মর্গে মর্গে মরদেহ খোঁজা কুমিল্লার আসিফ এখন উপদেষ্টা
‘আমিও যেন গর্ব করে বলতে পারি আসিফের কোন দুর্নীতি নেই’
অফিস রিপোর্টার।।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হওয়ায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার গ্রামের বাড়িতে খুশির আমেজ বইছে। মর্গে মর্গে মরদেহ খোঁজা আসিফ উপদেষ্টা হওয়ায় বিস্মিত এলাকাবাসী ও স্বজনরা। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আন্দিকুট ইউনিয়নের আকুবপুর গ্রামের মো. বিল্লাল হোসেন ও রোকসানা আক্তার দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান।
মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, আন্দোলনের প্রথমে বাধা দিয়েছিলাম। যেন বের না হয়। সে আমার কথা শুনেনি। বললাম, এত কষ্ট করে পড়াশোনা করালাম ভালো চাকরি করো, মানুষের মত মানুষ হও। তুমি আন্দোলনে গিয়ে আমার স্বপ্ন শেষ করিও না। সে আমাকে বলেছিল দোয়া করতে। কিছু করার ছিল না। আমি প্রতিবেলা নামাজে তার জন্য দোয়া করতাম। তার মাও দোয়া করতো, কান্নাকাটি করতো। আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখেন। এখন আল্লাহ তার শ্রম ও সততার পুরষ্কার দিয়েছেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, আসিফের বাবা আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে স্বামীসহ জাপানে আছেন। তৃতীয় বোন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ছোট বোন রাজধানীর হলিক্রস কলেজে পড়াশোনা করছেন।
আসিফ ২০১৩ সালে কুমিল্লার আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৮ম শ্রেণি পাস করেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এলাকার হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হন। আসিফ প্রথমবারেই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে।
শুক্রবার এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হলে বিল্লাল হোসেন আরো বলেন, তার এই সফলতার খবরে উপজেলাজুড়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। মসজিদে মসজিদে তার জন্য দোয়া ও মিষ্টি বিতরণ করছে স্থানীয় জনতা। অনেকে আসছেন তার বাড়ি ঘর দেখতে।
বিল্লাল হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকে আসিফ মিশুক ও অধিকার সচেতন। তার নেতৃত্ব দেয়ার আলাদা গুণ লক্ষ্য করেছি। সে যেখানেই গেছে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু কখনই কোন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমার কড়া নির্দেশনা ছিল যেন রাজনীতিতে না জড়িত হয়। কারণ আমার দাদা ছিলের এলাকার বিত্তশালী। ১০০ কানি সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। এরপর আমার বাবাসহ তার ভাইয়েরা ৮৫ কানি সম্পত্তি পায়। আমার এখন ৩০ কানি সম্পত্তি আর ঢাকার মাতুয়াইলে ফ্ল্যাট আছে। আমাদের টাকা পয়সার দরকার নেই। তাই বলেছি রাজনীতি আমাদের দরকার নেই।
তিনি বলেন, ছেলেকে সৎ ও যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কখনই দুর্নীতির শিক্ষা দেয়নি। আমরা আজ গাড়ি ভাড়া করে এসেছি। আমি চাই আমার ছেলেও যখন উপদেষ্টা থাকবে না তখন যেন গর্ব করে বলতে পারে আমি দুর্নীতি করিনি। আজ যেমন পাঞ্জাবি, টি-শার্ট পরে বঙ্গভবনে গেছে সে যেন এমনই সাধারণ থাকে। আমার ছেলের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। তাকে বাংলার ইতিহাস মনে রাখবে এটা আমার বিশ্বাস আছে। আর আমিও যেন গর্ব করে বলতে পারি আসিফ আমার ছেলে। তার কোন দুর্নীতি নেই।
বিল্লাল হোসেন আন্দোলনের প্রথম দিকের বিষয়ে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। অজানা আতংক আর উৎকন্ঠা নিয়ে প্রতিদিন আসিফ মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু ১৯জুলাই তার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার পর বিভিন্ন যায়গায় তাকে খোঁজ করেও পাইনি তখন আমরা এক প্রকার দিশেহারা হয়ে যাই। ২৩ জুলাই পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয় যে আসিফ মাহমুদকে গুম করা হয়েছে। তারপর আমরা শাহবাগ থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করতে গেলে দায়িত্বরত ওসি জিডি নেননি। সেখানে থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় যাই, সেখানেও একইভাবে আমাদের ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। তারপর ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে প্রতিটা ওয়ার্ডে খোঁজ করি কিন্তু আসিফের কোন সন্ধান না পেয়ে হাসপাতালের লাশ ঘরে গিয়ে খোজাঁখুজি করেও পাইনি। তারপর প্রেসক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আসিফের গুমের বিষয়টি দেশবাসীকে জানাই। ২৪শে জুলাই হাতিরঝিল এলাকায় আসিফ মাহমুদকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। এসময় তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিলে সেখান থেকে ২৬ জুলাই পুলিশ পরিচয়ে আবারো তাকে তুলে নিয়ে যায়। ২৭ জুলাই ডিবি কার্যালয় থেকে ফোন করে জানায় আপনার ছেলে ডিবি কার্যালয় আছে এসে দেখে যান। আমি আর আসিফের মা সেখানে গিয়ে দেখা করলে তাদেরকে ছেড়ে দিবে বললেও পরে আর ছাড়েনি। ডিবি প্রধান হারুন সাহেব আমার থেকে ভিডিও রেকর্ড নিতে চেয়েছিলো যে, সমন্বয়করা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা স্বেচ্ছায় দিয়েছে। কিন্তু আমি রাজি হইনি।