মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এডভোকেট আহমেদ আলী

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।

দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১০ জানুয়ারি শুক্রবার ২০২০ খ্রি. দিবাগত রাত ১টা ৪৭ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন ‘কুমিল্লার বাতিঘর’ হিসেবে বিবেচিত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আহমেদ আলী এডভোকেট। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। মৃত্যু-উত্তর কালে স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকায় তাঁর বয়স ৯৭ ছাপা হলেও তাঁর প্রকৃত বয়স ৮৮ বছর। কারণ তাঁর জীবৎকালে আমি যখন ২০০৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক গ্রন্থ যুদ্ধদিনের কথা রচনা করি তখন তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ১ মার্চ। তিনি ছিলেন কুমিল্লার কৃতীসন্তান। ভাষাসংগ্রামে তিনি রাজপথে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চল যুব শিবিরের উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার (কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রথম এ্যাডমিনিস্টেটর ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।

দৈনিক শিরোনাম-এ তাঁর মৃত্যুসংবাদের শিরোনাম ছিল ‘নিভে গেল কুমিল্লার বাতিঘর/চলে গেলেন ভাষাসৈনিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাড. আহমেদ আলী’। যথার্থ শিরোনাম। সংবাদটি লিখেছেনও দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহা। তাঁকে ধন্যবাদ। সত্যিকার অর্থেই আহমেদ আলী এডভোকেট ছিলেন কুমিল্লার রাজনৈতিক ইতিহাসের বাতিঘর। আমরা যারা সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখালেখি করি তারা রাজনৈতিক বিষয়ক যেকোনো তথ্যের জন্য তাঁর কাছে ছুটে যেতাম। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো তাঁর কাছ থেকে সহজে পেয়ে যেতাম। আমি যখন ২০১৬ সালে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান: ডেটলাইন শ্রীহাস্য শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করি, তখন তাঁর কাছে তথ্যের জন্য গিয়েছিলাম। তিনি অসুস্থ অবস্থায় এ বিষয়ে মূল্যবান তথ্য দিয়েছিলেন। আহমেদ আলী এডভোকেটকে আমি ‘চাচা’ বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। বলতেন, ‘তুমি নূরপর চাঁন মিয়া সরদার বাড়ির ছেলে। তোমাদের পরিবারটি এ শহরের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। ইতিহাসের অজানা অধ্যায়কে তুমি নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করছো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করছো। এটাই সত্যিকারের দেশপ্রেম।’ খানিকটা নীরব থেকে বলেছি, চাচা দোয়া করবেন। আসলে ইতিহাস চর্চাকে আমি কর্তব্য মনে করি। চাচা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। সেই চাচা আমাদের ছেড়ে অচিনপুরে পাড়ি দিয়েছেন। এ দুঃখটি কীভাবে সামাল দিই?

যে কথা বলছিলাম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও শ্রীহাস্যের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘মুজিব ভক্ত ও আওয়ামী লীগের আখড়া ছিল ওই এলাকা। তখন গণঅভ্যুত্থানের সময়। সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। এ আন্দোলনে ¯্রােতের মতো মানুষ সামিল হয়। চারদিক জ¦ালাও পোড়াও শ্লোগানে মুখরিত। ওই পরিস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলার বালাই থাকে না। আইউব সরকার তখন দারুণ বেকায়দায়। সারাদেশে মুসলিম লীগ দালালদের ধরপাকড় চলছে। ওই সময় শ্রীহাস্যে (বর্তমানে নাঙ্গলকোট উপজেলার একটি গ্রাম) একটি চুরির ঘটনা ঘটে। … পুলিশ আসামি ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তুলকালাম কা- ঘটে। ক্ষিপ্ত জনতা পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। সন্ধ্যায় পুলিশের লাশগুলো উদ্ধার করে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে নিয়ে আসা হয়। ৮টি লাশ। …. এরপর পাকিস্তানি পুলিশ শ্রীহাস্যসহ ৭-৮টি গ্রাম জ¦ালিয়ে দেয়। … এ করুণ দৃশ্য না দেখলে অনুভব করা যায় না। এ ঘটনা নিয়ে ৩৭ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। …. এ ঘটনা আইউব সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে আমার রচিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান: ডেট লাইন শ্রীহাস্য গ্রন্থে।
দুই.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রথম দেখা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জীবৎকালে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও গণপরিষদের সাবেক সদস্য আহমেদ আলী এডভোকেট বলেছিলেন, ‘আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সত্যি বলতে কী বঙ্গবন্ধুকে দেখে তখন আমারও মনঃপুত নেতা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। পাতলা ছিপছিপে গড়নের একজন যুবক রাজনীতি সম্পর্কে আর কী-ইবা বক্তব্য রাখবে। সভায় উপস্থিত লোকজনও এ নিয়ে কানাঘুষা করছিল। কিন্তু যখন বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন তখন সবার ধারণা পাল্টে গেল। সে-কী বক্তব্য! মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে। আর সে-ফুলকির আলোয় আলোকিত গোটা জনসমাবেশ। সেই দিনের সেই ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মানুষের ধারণাই পাল্টে যায়। অনেকেই বলতে থাকেন ভবিষ্যতে এ ছাত্রনেতা একজন মহান নেতা হিসেবে তাঁর অবস্থান মজবুত করবেন। বাস্তবে সাধারণ মানুষের সেই আশা অপূর্ণ থাকে নি। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ছাত্রনেতাই ছিলেন না, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন তিন প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদকের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে ৬ দফা উত্থাপন করেন। বৈঠক শেষে তিনি ঢাকায় আওয়ামী লীগ নির্বাহী কমিটির সভা ডাকেন। এতে আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতাদের কেউ কেউ মনঃক্ষুণœ হন। তারা বলেন, লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে ৬ দফা দাবি উত্থাপনের আগে বঙ্গবন্ধু কেন নির্বাহী কমিটির সভা ডাকেন নি. কেন আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেন নি। নির্বাহী কমিটির সভায় এ রকম পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অনেকটা কৌশল অবলম্বন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে সভা চালিয়ে যাবার কথা বলে দোতলায় চলে যান। কিছুক্ষণ পর স্লিপ দিয়ে তিনি এক এক করে ঊর্ধ্বতন নেতাদের দোতলায় ডাকেন এবং ৬ দফা উত্থাপনের দাবিটি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। যদি মেনে নেয়া না হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু দল থেকে তাঁর পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান।’

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এডভোকেট আহমেদ আলী আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ওই কৌশল অবলম্বন না করলে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে হয়তো দলে ভাঙনের সৃষ্টি হতো। ওই নির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধু লাহোরে উত্থাপিত ৬ দফার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রামের লালদিঘির ময়দানে। গ্রীণ এ্যারো ট্রেনে করে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্যরা চট্টগ্রাম যান।’ নির্ধারিত দিনের পূর্বদিন চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কুমিল্লা রেলস্টেশনে কুমিল্লার স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাঁর সাথে দেখা করেন। নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাথে এডভোকেট আহমেদ আলীও চট্টগ্রাম যাবার কথা ছিল। কিন্তু একটি মামলার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকায় তার অপারগতার কথা জানাতে তিনি স্টেশনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, তিনি চট্টগ্রামে ৬ দফা ঘোষণার পরদিন সড়ক পথে ঢাকা যাবেন। পথিমধ্যে কুমিল্লায় তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে এডভোকেট আহমেদ আলী তাঁর বাসায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপ্লবী নেতা অতীন্দ্রমোহন রায়, প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা আশুতোষ সিংহসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানান।

কুমিল্লা রেলস্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে এডভোকেট আহমেদ আলী বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবির প্রতি সমর্থনের জন্য কুমিল্লার মাটিতে প্রথম পথসভার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনি পরদিন সকালে কোতয়ালী থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অলি আহাম্মদকে ডেকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু তার বাসায় আসবেন। আসার পথে কুমিল্লা শহরের প্রবশেদ্বার চৌয়ারা বাজারে ৬ দফার পক্ষে পথসভার আয়োজন করে যেনো শ্লোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সে অনুসারে বাংলার মাটিতে কুমিল্লাতেই ৬ দফার প্রথম শ্লোগান দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু চৌয়ারাতে লোক সমাগম দেখে ও ৬ দফার পক্ষে শ্লোগান শুনে উৎসাহিত হন তথা তাঁর মনোবল বৃদ্ধি পায়। ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পরপরই কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুর এ সফর ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

তিন.
এ পর্যায়ে আহমেদ আলী এডভোকেটের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান বিষয়ক তাঁর সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করছি। আহমেদ আলী ১৯৩২ সালের ১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার শিবপুর ইউনিয়নের কাজলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম : মুন্সী হোসেন আলী। মাতার নাম : বারেক চান্দের নেছা। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে আহমেদ আলী তৃতীয়। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে বিএ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় হতে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম হোসনেয়ারা বেগম। ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ দম্পতির ৪ পুত্র ও ৫ কন্যা। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন প্রবীণ আইনজীবী ছিলেন।

গণপরিষদের সাবেক সদস্য আহমেদ আলী এডভোকেট মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ত্রিপুরায় পূর্বাঞ্চল যুবশিবির উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রিয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ১৯৬৯ সালে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। তখন সভাপতি ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহাম্মদ। আহমেদ আলী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

জীবৎকালে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ আমি কুমিল্লায় ছিলাম না। ২৩ মার্চ আমার নির্বাচনী এলাকায় আয়োজিত এক জনসভায় যোগদানের জন্য গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এর আগে ২২ মার্চ রাতে আমাকে খন্দকার মোশতাক টেলিফোন করে যেতে বারণ করেন। এর কারণ জুলফিকার আলী ভুট্টো ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে আলোচনা করেন তাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠনের পূর্বেই প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব করা হয়। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জহুর আহাম্মদ চৌধুরী, আমাকে ও শাহ মোয়াজ্জম হোসেনকে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনীত করা হয়েছিল। ফলে যে কোন মুহূর্তে আমার ডাক পরার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা আর হয় নি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেয়ায় সমস্ত দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভিত্তিতে অসহযোগ আন্দোরনের ডাক দেন। কুমিল্লায় তখন আওয়ামী লীগ অফিস ছিল রেসকোর্সে- বর্তমানে ইস্টার্ন ইয়াকুব প্লাজার পূর্বপ্রান্তে। ২৩ মার্চ কুমিল্লায় আবদুস সামাদ সাহেবের ছেলেরা তাদের বাসায় পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ২৪ ও ২৫ মার্চ আমি এলাকায় গণসংযোগ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। ২৬ মার্চ নাটঘর এলাকায় মিটিং করার সময় রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের দেয়া রেডিওতে শুনি- ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মিরা আক্রমণ করেছে। শুনি, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও আর্মি এসেছে। পরদিন বিদ্যাকুট হাই স্কুল মাঠে মিটিং করি ও মিটিং শেষে মিছিল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিই। আসলে তখনও বুঝি নি পাকিস্তানি আর্মিরা নির্বিচারে এ-দেশের নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে।’

মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই ২৬ মার্চ প্রথমে মেজর খালেদ মোর্শারফ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চট্টগ্রামের কালুর ঘাটের মতো যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও প্রচার মাধ্যমের সুবিধা থাকতো হয়তো মেজর খালেদ মোর্শারফের কণ্ঠে এ-দেশের মানুষ প্রথম স্বাধীনতার ডাকই শুধু শুনতো না, সেনাবিদ্রোহের (বাঙালি) কথাও শুনতে পেতো। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই প্রথম মেজর খালেদ মোর্শারফ মুক্তিবাহিনী গঠনের ঘোষণা দেন।’

আহমেদ আলী বলেন, “জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ যখন চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের জন্য যাচ্ছিলেন তখন যাবার পথে ক্যাপ্টেন অলি আহাম্মদ তাকে বাধা দেন। অলি বলেন, ‘স্যার! আপনি অস্ত্র খালাস করতে যাবে না, কারণ এ-অস্ত্র পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর ব্যবহার করবে।’ বাধা পেয়ে জিয়াউর রহমান কালুর ঘাটে ফিরে আসেন।”

প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আহমেদ আলী বলেন, ‘খালেদ মোর্শরফের সাথে আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেখা হয়। আমার জানা মতে বঙ্গবন্ধুর সাথে যে সমস্ত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের যোগাযোগ ছিল, তাদের মধ্যে খালেদ মোর্শারফ অন্যতম ছিলেন। খালেদ মোর্শারফ যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেট যাচ্ছিলেন তখন তার সাথে কর্ণেল খিজির হায়াত খান নামে একজন পাঞ্জাবি কর্ণেল ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা গিয়ে দেখি পাঞ্জাবি এ-অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে মেজর সফিউল্লা দলবলসহ তখন গাজীপুর থেকে ভৈরব আসেন। তার সাথে খালেদ মোর্শারফের যোগাযোগ হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন বাঙালি সৈনিকদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। অনেকটা মিনি ক্যান্টনমেন্টের মতো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাঙালিদের শক্ত অবস্থানের কারণে ঢাকায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয নেতারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আগরতলা যাবার সাহস পায়।’

তাজউদ্দিন আহাম্মদ দিল্লী থেকে আগরতলায় আসেন। ১০ এপ্রিল আগরতলা সার্কিট হাউসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। মন্ত্রীসভা গঠন প্রসঙ্গে আহমেদ আলী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার জন্য তাজউদ্দিন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি দিল্লিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন নি, তিনি আত্মগোপন করে আছেন। তিনি আমাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নিতে বলেছেন।’ অন্যদিকে দিল্লী থেকে প্লেনে করে আগরতলায় পৌঁছে বলেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধী আমাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য বলেছেন।’ তখন আগরতলা সার্কিট হাউসে অবস্থানরত শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁর কথা উপেক্ষা করতে পারেন নি।”

জীবৎকালে কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও স্মৃতি কুটিরে এ-সাক্ষাৎকার দেয়া কালে কিছুক্ষণ চুপ থেকে এডভোকেট আহমেদ আলী বলেন, ‘অবশ্য এটাও সত্য, তাজউদ্দিনের মতো দৃঢ় মনোবলের লোক থাকাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। অন্য কেউ হলে আপস করে ফেলতো।’ মন্ত্রীসভা গঠনের পর মন্ত্রীসভার সকল সদস্য কলিকাতা চলে যান। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার আ¤্রকাননে এ-মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়।

এডভোকেট আহমেদ আলী অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলেন, ‘১০ এপ্রিল আগরতলায় মন্ত্রীসভা গঠনকালে বহু গুরুত্বপূর্ণ গঠনাবলী সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু এগুলো আলোচনায় আসছে না। অথচ ১৭ এপ্রিল এ-মন্ত্রীসভায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে বিশেষ প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমার মতে দুটো ঘটনাই সমভাবে আলোচনায় আসা উচিৎ। তা না হলে মন্ত্রীসভা গঠনের ইতিহাস বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে।’

মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সামরিকভাবে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রশাসনিকভাবে পূর্বাঞ্চলকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। ‘লিবারেশন এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল’ নামে একটি ‘হাই পাওয়ার্ড’ কমিটি গঠন করা হয়। জহুর আহাম্মদ চৌধুরী ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় কমিটির প্রধান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টার্গেট ছিল পূর্ব পাকিস্তানের যুবশক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া, এ-লক্ষ্যে তারা যুবকদের বিনা অজুহাতে হত্যা করতে শুরু করে। তাদের ভয়ে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতে বিভিন্ন স্থানে এ-দেশের যুবকরা ঘোরাঘুরি করতে থাকে। তাদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করেন কুমিল্লার কৃতীসন্তান হাবিবুর রহমান। যুদ্ধকালীন সময়ে যিনি আবু ইউসুফ নামে পরিচিত ছিলেন। যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তাব ইন্দ্রিরা গান্ধী প্রথম নাকচ করে দেন। পরে নেহেরু মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রী ড. ত্রিগুণা সেনের সহযোগিতায় হাবিবুর রহমান এ-প্রস্তাব অনুমোদন পান এবং সে-অনুযায়ী কাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় যুব শিবির। এ-যুব শিবির থেকে মুক্তিযোদ্ধ রিক্রুট করা হতো। এ মুক্তিযোদ্ধাদের দুভাগে ভাগ করা হয়। একটি ভিত্তি ফোর্স, অন্যটি সক্রিয়া মুক্তিযোদ্ধা। ভিত্তি ফোর্সের দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকাÑখাওয়া, অস্ত্র মজুদ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রত্যেক যুব ক্যাম্পে একজন গণপ্রতিনিধি যুবকদের সঙ্গ দিবেন, সার্বিক দায়িত্বে একজন ক্যাম্প চীফ থাকবেন, একজন ডেপুটি চীফ থাকবেন, যিনি অবশ্যই একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর থাকবেন- মোটামুটি এ-অবয়বে ৩৪টি যুবক্যাম্প চালু হয়। হোল্ডিং ক্যাম্প থেকে যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে হতো। প্রশিক্ষণ শেষে সেক্টর কমান্ডে রিপোর্ট করলে তাদের অঞ্চল ভাগ করে দেয়া হতো। গোকুল নগর বেইস্ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান। ক্যাপ্টেন সুজাত আলী ছিলেন পালাটোনা বেইস্ ক্যাম্পের দায়িত্বে। যুব শিবিরগুলোকে শরণার্থী শিবির হিসেবে গণ্য করা হলেও এ-শিবিরগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব ছিল তুলনামূলকভাবে অনেকটা বেশি। ভবিষ্যৎ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুবকদের আলাদাভাগে মূল্যায়ন করা হতো। প্রত্যেক যুবকের জন্য প্রতিদিন দু’টাকা বরাদ্দ ছিল। প্রতিটি যুব ক্যাম্পে এক থেকে দেড় হাজার যুবক ছিল।

পূর্বাঞ্চলের যুব শিবিরগুলো নিয়ম ও শৃঙ্খলা অনুযায়ী চলার জন্য ১৪ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘পূর্বাঞ্চলীয় যুব শিবির উপদেষ্টা পরিষদ।’ পূর্বাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত প্রতি জেলা হতে একজন করে সদস্য নিয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট এ-পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন আহমেদ আলী। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন- গাজী গোলাম মোস্তফা (ঢাকা), মোঃ ইলিয়াছ (সিলেট), খালেদ মোহাম্মদ আলী (নোয়াখালী) ও আবদুল্লা হারুন (চট্টগ্রাম) এছাড়া দুজন পরিচালক ছিলেন। একজন নূর ইসলাম চৌধুরী, অন্যজন হাবিবুর রহমান। পূর্বাঞ্চলকে প্রশাসনিকভাবে চারটি জোনো ভাগ করা হলেও সমগ্র পূর্বাঞ্চলে যুব শিবির উপদেষ্টা পরিষদ ছিল একটিই। আগরতলায় কৃষ্ণনগরে ছিল জয় বাংলা অফিস। ওই অফিসের একপাশে বসতেন জহুর আহাম্মদ চৌধুরী, অন্যপাশে এডভোকেট আহমেদ আলী।

আহমেদ আলী জয় বাংলা অফিস ঘিরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “একদিন আমার অফিসের বারান্দায় একজন বৃদ্ধ লোক ঘোরাঘুরি করতে দেখে পিওনকে দিয়ে তাঁকে কাছে আসতে বলি। লোকটি আমার রুমে প্রবেশ করেই বলেন, ‘আমি কুমিল্লার আহাম্মদ আলীকে খুঁজতেছি।’ অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকাই। তিনি আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, ‘আমি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা- কফিল উদ্দিন চৌধুরী। আমি আওয়ামী লীগ করি। পঁচা গন্ধে যেমন মাছির আগমন ঘটে, তেমনি আওয়ামী লীগের গন্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ হতে পারে, এ-আশংকায় আমার ছেলে বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাকে আগরতলায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। নিরুপায় হয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। কারণ আপনি আমার শ^শুর দেশের লোক।”

আহমেদ আলী তাঁর কথা শুনে অবাক হয়ে যান। তিনি তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে চেয়ার টেনে তাঁর পাশে বসান এবং প্রতিদিন দেখা করতে বলেন। পরবর্তী সময়ে কফিল উদ্দিন চৌধুরী যুব শিবিরের বিভিন্ন কাজে আহমেদ আলীকে সহযোগিতা করেছেন।

এডভোকেট আহমেদ আলী বলেন, ‘কফিল উদ্দিন চৌধুরী অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। যুব শিবিরগুলোর অভাব-অভিযোগ নিয়ে অফিসে প্রায় উচ্চস্বরে কথাবার্তা হতো। কফিল উদ্দিন চৌধুরী সাহেব অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে ও রসালো কথাবার্তার মধ্যদিয়ে উত্তপ্ত বাক্যগুলোকে শীতল করে দিতেন।’

আহমেদ আলী পূর্বাঞ্চল যুব শিবির উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে জয় বাংলা অফিসে নিয়মিত বসার পাশাপাশি যুব শিবিরগুলো পরিদর্শন করতেন। যুবকদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন। যুব শিবির পরিদর্শনকালে একদিন তাঁকে জানানো হয়, ২নং সেক্টরে হেড কোয়ার্টার মেলাঘরে মেজর খালেদ মোর্শারফ ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের যেভাবে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন সেভাবে ছাত্রলীগের ছেলেরা পাচ্ছে না। এ-অবস্থায় আহমেদ আলী মেলাঘরে একটি নতুন যুবশিবির চালু করেন। আবুল কালাম মজুমদারকে এ-শিবিরের ‘ক্যাম্প চীফ’ করা হয়। হাতিমারা ক্যাম্প পরিচালনার রশীদ ইঞ্জিনিয়ার অপরাগতা প্রকাশ করায় সাথে সাথেই আফজল খানকে ক্যাম্প চীফ হিসেবে নিয়োগ দান করা হয়।

পূর্বাঞ্চল যুব শিবির উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে আহমেদ আলী সোনামুড়া থেকে উদয়পুর এবং ওখান থেকে চৌদ্দগ্রামের নয়াবাজার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ৮ ডিসেম্বর পদার্পণ করেন। ওইদিন বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে তিনি আনুষ্ঠানিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা জহুর আহাম্মদ চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এডভোকেট আহমেদ আলী বলেন, ‘বৃটিশ আমলে পুঁজিপতিদের জন্য রাজনীতি প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। সামরিক শাসনের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুঁজিপতিরা আসেন। যেজন্য বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ভোগবাদী-সওদাগরদের হাতে বন্দী হয়ে আছে। ত্যাগী নেতাকর্মীরা দিন দিন রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। একই সাথে সাধারণ মানুষও বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ-দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করাই এখন রাজনীতির আদর্শ হওয়া প্রয়োজন।’ এডভোকেট আহমেদ আলীর উপরিউক্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে এদেশের রাজনীতির আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধতা একান্ত কাম্য। তাঁর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।