মৌলভি স্যারের ‘সত্য’ প্রচারে ৯২বছরের জয় গোবিন্দ

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
জয় গোবিন্দ দেবনাথ। বয়স ৯২ বছর। এখনও সারা শহর হেঁটে বেড়ান। মাঝে মধ্যে টিউশনি করেন। শিক্ষকতা করেছেন প্রায় সাত দশক। এই সময়ে হাই স্কুল শিক্ষক মৌলভি স্যার সিদ্দিক উল্লাহর দুইটি কথা তার জীবন পাল্টে দিয়েছে। তিনি সেই দুইটি বাক্য ছড়িয়ে ফিরছেন তার হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে।
লক্ষীপুর জেলা সদরের গন্ধর্ব্যপুর গ্রামে ১৯৩৮সালে জয় গোবিন্দ দেবনাথ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নবীনচন্দ্র দেবনাথ মা অন্নদা সুন্দরী দেবনাথ। সাত ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। সবাই প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৫৩সালে লক্ষীপুর হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। লক্ষীপুর হাইস্কুলের আগে স্থানীয় ভবানীপুর স্কুলে কিছু দিন পড়েন। মেট্রিক পাশের পর ভর্তি হতে কুমিল্লা যাত্রা করেন। ভর্তি হবেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। তার মা অন্নদা সুন্দরী দেবনাথ বলেন-মৌলভি স্যারের দোয়া নিতে। মৌলভি স্যারের দোয়া নিতে গেলে তিনি ভালো করে লেখাপড়ার কথা বলেন। কিন্তু জয় গোবিন্দ দেবনাথের দাবি তাকে যেন মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেন। এতে মৌলভি স্যার হেসে উঠেন। মাথায় হাত দিয়ে বলেন, দুইটি বিষয় মনে রাখবে। কখনও মিথ্যা বলো না, কারো মনে কষ্ট দিও না। তিনি এই দুইটি বাক্যকে তার জীবনের পাথেয় বলে করেন। তিনি ভিক্টোরিয়া কলেজে পেয়েছেন ড. আখতার হামিদ খানের মতো নামকরা অধ্যক্ষকে। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন সুধীর সেন,অজিত নন্দী,বিভুরঞ্জন গুহ ও মনিন্দ্র দেবের মতো গুণী শিক্ষকদের। ১৯৬৩সালে বিএসসি পাস করেন। জগন্নাথ কলেজে এমএসসিতে ভর্তি হলেও সম্পন্ন করতে পারেননি। পরিবারের দায়িত্ব এসে কাঁধে পড়ে। ওই বছরই কুমিল্লার ইলিয়ট টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে তার চাকরি হয়। যদিও প্রতিষ্ঠনটির পওে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। পড়াতেন গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান। ১১০টাকা বেতনের চাকরি। তখন চাউলের মণ ১৬টাকা। সোনার ভরি ১৬০টাকা। ইলিয়ট টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে তিনি টানা ৩১বছর শিক্ষকতা করেন। এছাড়া তিনি কুমিল্লা মডার্ন হাই স্কুল,ফরিদা বিদ্যায়তন ও ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট হাই স্কুলে নিয়মিত ও খ-কালীন শিক্ষকতা করেন। তিনি ভলিবল খেলতেন। প্রতিষ্ঠানের ফুটবল টিম পরিচালনা করতেন।

inside post


ভাইয়ের ছেলেদের দায়িত্ব নিতে গিয়ে বিয়ে করেন ৩৮বছর বয়সে। ১৯৭২সালে বিয়ে করেন অতিথিদের চা খাইয়ে। স্ত্রী মঞ্জু রানী দেবনাথ। তার এক ছেলে জয়ন্ত কুমার দেবনাথ স্কুল শিক্ষক। মেয়ে ডা. জয়ন্তী রানী দেবনাথ জুনিয়র কনসালটেন্ট। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলের নাতিকে নিয়ে,ছাত্র পড়িয়ে ও ধর্ম পালনে তার সময় কাটে।
জয় গোবিন্দ দেবনাথের সাথে দেখা হয় নগরীর ধর্মসাগরপাড়ে। সেখানে সকালে হাঁটতে এসেছেন। হাঁটা শেষে পরিচিতজনদের খবর নিয়ে সময় কাটান তিনি।
এক ছাত্রকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,বিমল চন্দ্র শীল নামের এক ছাত্র টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে আসে। উত্তীর্ণ হয়নি। বাইরে কান্না করছে। তিনি কান্নার কারণ জানতে চাইলে সে ভর্তি হতে চায় বলে জানায়। প্রিন্সিপালকে বলে ভর্তি করিয়ে দেন। ভর্তি ফি তিনি দেন। হোস্টেলে রাখতে চাইলে বলে-খাবারের টাকা তার কাছে নেই। পরে এক বাড়িতে লজিং পাঠান। সে ছাত্র পরে ভালো রেজাল্ট করে। ভালো চাকরি পায়। এখনও যোগাযোগ রাখে।
শহরের পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন,১৯৫৩-৫৪সালে কান্দিরপাড় দিয়ে হাঁটতেও ভয় লাগতো। নিরব নিস্তব্ধ। এত দোকানপাট ছিলো না। এখন শহর জমজমাট তবে আগের মতো প্রাণ নেই।
তিনি আরো বলেন,জীবনের এই সময়ে এসে নিজেকে পরিতৃপ্ত মনে হচ্ছে। যেভাবে চেয়েছেন জীবনকে সেভাবে গোছাতে পেরেছেন। মৌলভি স্যারের দুইটি কথা তার জীবনের সফলতার মূল চাবিকাঠি বলে তিনি মনে করেন। শিক্ষকতার মাধ্যমে হাজারো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ভালোবাসা পেয়েছেন।
সাংস্কৃতিক সংগঠক রফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন,একজন মিষ্টিভাষী ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে জয়ন্ত স্যারকে পেয়েছি। তিনি নগরীর একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। নগরীর নানা বাঁক বদল তার নখদর্পণে।
ক্রীড়া সংগঠক বদরুল হুদা জেনু বলেন,তিনি শিক্ষার্থী দরদী একজন শিক্ষক। তার সময়ে তিনি একজন নিবেদিত প্রাণ ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। টিম পরিচালনায় তিনি ছিলেন বেশ দক্ষ সংগঠক।

আরো পড়ুন