শক্তিশালী বুঝাতে গরু ঢিল করে ধরা !

হুমায়ুন কবির।।
শৈশবের স্মৃতি ‘কোরবানি ঈদ’ বা ‘ঈদুল আযহা’ সত্যি মজার এবং আরও বেদনাদায়কও বটে। মজার এমন যে, বাবার সাথে কোরবানি ঈদের সলাতে যেতাম। সে কারণে ‘মা’ আমাদেরকে খুব ভোরে ভোরে ঢেকে দিতেন। আসলে আমি একটু আলসে ছিলাম, আর ‘মা’ এসে বিছানার বালিশ আর কাঁথা নিয়ে নিতেন। অগত্যা ঘুম ছেড়ে উঠতেই হত। সকালে উঠেই গোসল সেরে পাঞ্জাবি আর পায়জমা পরে ঈদগাহে যেতাম। ঈদগাহ যাওয়ার পূর্বে বাবা আমাদেরকে নিয়ে এক রাস্তায় যেতেন আর ফিরার সময় আরেক রাস্তা ব্যবহার করতেন। এরকম করার কারণ হিসেবে বলতেন- আমাদের রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা করতেন। তাই এটা সুন্নাহ। আমরাও বাবাকে ফলো করতাম। কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতে হবে। এটাও রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ। আমরাও বাবার নির্দেশ মেনে চলতাম অক্ষরে অক্ষরে। এখন ‘মা-বাবা’ আমাদের নাই। এখন সেই সুন্নাহ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এবার এসেই মায়ের হাতের ‘সেমাই’ যার কোন তুলনা হয় না। পৃথিবীর সব খাবারের কাছে ফেল মায়ের হাতের ‘সেমাই’।
সেমাই ও মুরগি দিয়ে সকালের রান্না খাওয়া সবাই এক সাথে বসে খেতে হবে। এটা এধরনের কড়া নিয়ম। তারপর এবার ষাঁড় বা গরু আমাদের সময়ে বাড়িতে বাড়িতে যেতাম ষাঁড় ধরে শোয়ানোর জন্য। আর আমি ধরতাম গলার কাছ দিয়ে যাতে গরু নড়তে চড়তে না পারে। খুব সহজেই কোরবানি হয়ে যায়। এভাবে কোরবানিই হয়ে যায় একের পর এক গরু। আর সামনে থেকে ধরার কারণে গরুর গায়ের জামা রক্ত রঞ্জিত করেছি। এ এক অন্য রকম সফলতা। সেই সময় সবাই কসাই হয়ে যেতাম। সবাই সবার গরু মিলে যবেহ করতাম।
আর আমি ইমাম সাহেবের ছুরিখানা আমার কাছেই রাখতাম। যাতে আমাদের গরুটা সবার আগে জবাই হয়। আমাদের নিজের গরু কোরবানির সময় একটু দুষ্টামি করতাম। তাহলো সবার আগে যখন মাথায় ধরতাম তখন একটু ঢিল করে ধরতাম। আর ওমনি গরুটা উঠে যেত। এবার সবাই মিলে ধরে আর আমি ঢিল করে ধরতাম। গরুটা আবার উঠে যেত। এরপর তৃতীয়বারে গরু জবাই হত। আর বিকেল বেলা বলে বেড়াতাম, “আমাদের গরুটা সেই রকম গরু। তিন তিন বার তাকে সোয়ানো যায়নি, কি শক্তিশালী গরু রে বাবা?” সবাই তখন বলত, “গরু দেখেছি হাসানদের গরু। তিন তিন বার উঠে গেছে। এমন গরু আর দেখিনি”। আমার ভাব দেখে কে। একবার এরকম হল যে গরু গলা কেটেছে অর্ধেক আর গরু পুরো গ্রামময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই দিন কান ধরে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এই রকম আর করব না।
দুই
এমন ঘটনার আমি আজও মনে করি। সেদিনের সেই ঘটনার চরিত্রের নাম খালি ভিন্ন। সেদিন বিকেল বেলায় পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমাদের কুসুমের মা কুসুমের বাবাকে বললেন, আমি তো পিঁয়াজ মরিচ কেটে রেখেছিলাম, কেউ তো গোশত পাঠালো না! প্রতিবেশীরা আমাদের কথা ভুলে গেলো না তো ? আপনি কি একটু গিয়ে দেখবেন? কুসুমের বাবাঃ তুমি তো জানো আজ পর্যন্ত কারো কাছে আমি হাত পাতিনি। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই কোন না কোন ব্যবস্থা করে দেবেন।
দুপুরের পর পীড়াপীড়িতে বের না হয়ে পারলেন না। প্রথম গেলেন বড় সাহেবের বাড়িতে। বললেন,বড় সাহেব! আমি আপনার পড়শী। কিছু গোশত দেবেন? লোকটি ভীষণ রকমের কিপ্টা প্রকৃতির।
গোশত চাইতেই বড় সাহেবের চেহারা গোস্বায় লাল হয়ে গেল। তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, কি জানি কোত্থেকে গোশত চাইতে চলে আসে-বলেই ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এঘটনা শুনেছিলাম পরে। অপমানে কুসুমের বাবার চোখে পানি চলে আসলো। ভারী পায়ে চলতে চলতে এবার গেলেন মিঁয়া সাহেবের ঘরের দিকে, দরজায় করাঘাত করে বিনীতভাবে কিছু গোশত চাইলেন। মিঁয়া সাহেব গোশতের কথা শুনেই বিরক্তিভরে তাকালেন,পলিথিনে কয়েক টুকরো গোশত দিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলেন। যাক ছোট মেয়েটাকে তো একটা বুঝ দেয়া যাবে, এমনটা ভাবতে ভাবতে কুসুমের বাবা ঘরে ফিরে এলেন। ঘরে ফিরে পলিথিন খুলে দেখলেন শুধু দুটো হাড্ডি আর চর্বি। চুপচাপ রুমে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
এরই মধ্যে ছোট কুসুম বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা! গোশত লাগবে না। আমি গোস্ত খাবো না, আমার পেট ব্যাথা করছে। মেয়ের একথা শুনে বাবা আর চাপা কান্না ধরে রাখতে পারলেন না।
এমন সময় বাইরে থেকে সবজি বিক্রেতা আকরাম ভাই ডাক দিলো। কুসুমের বাপ ঘরে আছেন ? কুসুমের আব্বু দরজা খুলতেই আকরাম ভাই তিন- চার কেজি গোশতের একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, গ্রাম থেকে ছোট ভাই নিয়ে এসেছে। এতো গোশত কি একা খাওয়া সম্ভব, বলেন? এটা আপনারা খাবেন। আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় কুসুমের বাবা ভেজা চোখ মুছতে লাগলেন। অন্তর থেকে আকরামের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। গোশত রান্না করে সবাই মজা করে খেয়ে উঠতে না উঠতেই প্রচন্ড তুফান শুরু হলো। বিদ্যুৎও চলে গেল। সারাদিন গেল, এমনকি দ্বিতীয় দিনও বিদ্যুৎ এলো না, তুফানে ট্রান্সমিটার জ্বলে গিয়েছিলো ।
কুসুমের বাবা তৃতীয় দিন কুসুমকে নিয়ে হাঁটতে বের হলেন। বাবা-মেয়ে দেখলো,
বড় সাহেব ও মিঁয়া সাহেব গোশতে ভরা অনেকগুলো পোঁটলা ডাস্টবিনে ফেলছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজে থাকা সব গোশত নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফেলে দেয়া পঁচা গোশতের উপর একদল কুকুরকে হামলে পড়তে দেখে কুসুম বলল, বাবা তারা কি কুকুরদের খাওয়ানোর জন্য কুরবানি করেছিলেন?
পাশ থেকে মিঁয়া সাহেব ও হাজী সাহেব ছোট মেয়েটির কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন।
হ্যাঁ, এটিই আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের বাস্তবচিত্র হয়েছিল। অভাবীদের ঘরে ঘরে কুরবানির গোশত ঘরে ঘরে পোঁছে দেই। আমার বাবা এ কাজটা করতেন। একবার তিনি রেল ইস্টিশনে চলে গেলেন মাংস বিলানোর জন্য। খলিফা ওমরের জামানায় এসে পড়লাম নাকি। এমনি করে লোকে টিপ্পনি কাটতে লাগল।
আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে উত্তম বিনিময় পাওয়ার আশায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সমস্ত নেক আমল গুলো কবুল করুন। আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো যেন মাফ করে দেন।
লেখক:উদ্যোক্তা,টাটকা এগ্রোফার্ম,মিথিলাপুর,বুড়িচং।
