শতবর্ষী মাইথারকান্দি খালের কান্না!

আবদুল্লাহ আল মারুফ॥
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপশহরের উত্তর প্রান্তে সাপের মতো বয়ে গেছে মাইথারকান্দি খাল। ভারত থেকে আসা গোমতী নদীর শাখা নদ কালাডুমুর থেকে মাইথারকান্দির উৎপত্তি। এককালে এটি ছিল এই জনপদের জনপ্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাণিজ্যের কল্যাণে ও সময়ের প্রয়োজনে এই খাল পাড়ে গড়ে উঠে এক নগর। নাম তার গৌরীপুর। বর্তমান সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপরের একটি উল্লেখযোগ্য বাজার। গৌরীপুর বাজারের জন্মে যার অবদান আর কোটি টাকার লেনদেন; সেই খালটিকেই গলা টিপে হত্যা করছে বাজারের ব্যবসায়ীরা। তাই জীবন নিয়ে লড়াই করে এখন একরকম মুমূর্ষু অবস্থায় টিকে আছে খালটি।
সূত্র বলছে, দাউদকান্দি উপজেলার মাইথারকান্দি-গৌরীপুর খাল গোমতীর শাখা নদ কালাডুমুর থেকে উৎপত্তি হয়। গৌরীপুর বাজার এবং সুবল আফতাব উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে মাইথার কান্দি, পলুদ্দির পার, পেন্নাই, হরিপুর, আমিরাবাদ, ইছাপুর, তিনচিটা হয়ে বারিকান্দি, রাঙা সিংগুলিয়া, সুন্দলপুর, জুরানপুর, গোয়ালমারি, মোল্লাকান্দি দিয়ে খিরাই নদীতে মিশেছে। খিরাই নদী আবার মেঘনায় যুক্ত হয়েছে। এটি বড় খাল নামেও পরিচিত। আনুমানিক ১২ কিলোমিটারের বেশি মাইথারকান্দি খাল কয়েকটি ইউনিয়ন অতিক্রম করেছে। এ খালের পানিতে উপরের গ্রাম গুলো বোরোধানের আবাদসহ সবধরনের ফসলে সেচের সুবিধা পেতো। বর্তমানে গৌরীপুর বাজারের বর্জ্যে খালের মুখ ভরাট করে ফেলেছে। বিভিন্ন জায়গায় যার যার মত করে দখলে দূষণে হত্যা করা হচ্ছে। এতে করে ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদনও।
সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই বাজার ও পরবর্তীতে খাল ঘুরে দেখা গেছে ভয়ঙ্কর দখলের চিত্র। মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনের বাঁ পাশে দাউদকান্দি বাজারের একটি বড় অংশ। বাজারের ভেতরে দিয়ে যাওয়ার সময়ে চোখে পডলো পরিষ্কার ও শুকনো সব গলি। বাজারের শেষপ্রান্তে সুবল আফতাব উচ্চ বিদ্যালয়ের গেট। বাজারের পাশেই স্কুলটি। শত শিক্ষার্থী এই স্কুলে প্রবেশের পূর্বে খাল ডিঙিয়ে যেতে হয়। খালের দিকে নজর পড়লেই মনে হবে আত্মচিৎকার করে খালটি বাঁচতে চাচ্ছে।
খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই বললেই চলে। এর মাঝে দাঁড়কাকের দল লাপিয়ে ঝাঁপিয়ে খালে পড়ে থাকা আবর্জনা থেকে খাবার খাচ্ছে। আবার কিছু দাঁড়কাক ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, হাসপাতালের আবর্জনা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের উচ্ছিষ্ট খাবার, বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরির কেমিক্যাল, মরা মুরগি, মরা পশু-পাখি, বাথরুমের ময়লাসহ এমন কিছু বাদ নেই যা এই খালের বুকে নেই।
আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঝে মাঝে এই এলাকায় আসা দায় হয়ে দাঁড়ায়। দুর্গন্ধে শিক্ষার্থীরাও শ্রেণিকক্ষে বসে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। এসব ময়লা ফেলে যেমন পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে তেমনি শতবর্ষী এই খালও হত্যা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করা স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, বাজারের ব্যবসায়ীরা ছাড়া কেউই এই খালে ময়লা ফেলেন না। গত ৫ বছর ধরে এই খালে অধিক পরিমাণে ময়লা ফেলা হচ্ছে যেকারণে খালটির এই দশা। শিগগিরই ব্যবস্থা না নিলে কয়েক বছরের মাঝেই খালটি মরে যাবে। এতে করে কয়েক হেক্টর জমি অনাবাদী হয়ে পড়বে।
উপজেলার আমিরাবাদের বাসিন্দা হানিফ খান বলেন, এই খালটি এক সময়ে জল টলটলে ছিলো। এটি দিয়ে নৌকা চলতো। জেলেরা মাছ ধরতো। কৃষক এর পানি জমিতে ব্যবহার করতেন। এটি এখন মরা খাল। ১০ বছর ধরে খালটির দুরাবস্থা। খালটিকে বাঁচিয়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
স্থানীয় কৃষি ও পরিবেশ সংগঠক মতিন সৈকত বলেন, এভাবে একটি খালকে ভরাট পরিবেশের জন্য হুমকি। বিশেষ করে আশপাশের অন্তত ৩০ গ্রামের কৃষকরা তা অনুভব করছেন। আগে এসব গ্রামে খালের মাধ্যমে সেচের পানি যেত। এখন তা আর হচ্ছেনা। অচিরেই খালটিকে আগের রূপ ফিরিয়ে দিয়ে কৃষকদের বরো উৎপাদনে আগ্রহী করার আহবান জানাই। এতে দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজারের পরিবেশও বদলে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বাণিজ্যের জন্য এই খালটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একসময় এই খালে নৌকা ভিড়তো। খালের তীরে ছেলে মেয়েরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গোসল করতো। জেলেরা মাছ ধরতো। রান্নার কাজে এই কালের পানি ব্যবহার হতো। এখনতো এসবের প্রশ্নই আসেনা। আমরা চাই এই নদী তার শৈশব ফিরে পাক।
দাউদকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিনুল হাসান বলেন,এটি কয়েকবার পরিষ্কার করা হয়েছে। আবারও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। আবর্জনা ফেলার জন্য আমরা জায়গা খুঁজছি।
উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সুমন বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাজারের ব্যবসায়ীদের সচেতনের চেষ্টা করেছি। খালটি সচলের জন্য আমরা পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুমিল্লার উপপরিচালক মো. আইউব মাহমুদ বলেন, আমি আসার পর থেকে খবর নিচ্ছি। কোথাও কোন আবাদী জমি পতিত অবস্থায় আছে কিনা! এই খালের খবর আমি জানতাম না। আমি এক্ষুণি খবর নিয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।