শব্দ দূষণে শ্রবণশক্তি কমছে কুমিল্লা নগরবাসীর- -আলী আকবর মাসুম

এবার মিসরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ শিরোনামে আরও একটি বিশ^ জলবায়ু সম্মেলন শেষ হয়ে গেল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের বিষয়বস্তু ও গুরুত্বের বিষয়টি বলা যায় সব দেশের কাছেই প্রাধান্য পেয়েছে । বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নেয়া সরকারের প্রতিনিধিগনও জলবায়ুর ক্ষতিতে ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে সম্মেলনে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন । সম্মেলনে মূলত উন্নয়নশীল ও ক্ষতিগ্রস্থ দেশ গুলোকে জলবায়ুর আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান ও উন্নত দেশ গুলোর কার্বন নিসঃরণ কামানোর বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে । তারসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ দেশেগুলোকে অর্থ সহায়তা প্রদানে “লস অ্যান্ড ড্যামেজ” নামে একটি সহায়তা তহবিল গঠনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে আলাদা ভাবে কোন দেশের পরিবেশগত অবস্থা কতটা ক্ষতিতে রয়েছে এবং পৃথক ভাবে প্রতিটি দেশ তার প্রেক্ষিতে কী কী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে তার কোনো তথ্য এখনো জানা যায়নি । আমাদের দেশ বাংলাদেশের কথা যদি বলি, জলবায়ুর একরকম ক্ষতির সঙ্গে পরিবেশের অভ্যন্তরিণ ক্ষতি যতটা অসহনীয় অবস্থার মুখে পড়েছে ও তারসঙ্গে প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডও অনেক বেড়েছে । সারা দেশের এই ভয়ানক অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশের সকল মানুষ সার্বিক অর্থে যেমন ঝুঁকিতে আছেন, আবার অঞ্চলগত ভাবেও প্রকৃতি ও পরিবেশের নানা ক্ষতিতে বাড়ছে অনেক ভোগান্তি। কুমিল্লা জেলার ক্ষেত্রেও- প্রকৃতির বিনাশ ও পরিবেশের বিপন্নতার কতটা বিপদের মাঝে আমরা সবাই আছি, তার সবকিছু সঠিক ভাবে অনুভব করি না বা করার প্রয়োজন মনে করি না বলেই হয়তো আমাদের প্রত্যেকের এক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব যা রয়েছে তা পালনে অনেকটাই দূরে রয়েছি । রাজধানী ঢাকা বায়ু ও শব্দ দূষিত একটি শীর্ষ নগরে পরিণত হবার পর কুমিল্লা ও তার আশপাশের জেলা গুলো দূষণের বিপদ থেকে কতটা মুক্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । আবার তারসঙ্গে অল্প কদিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে, কুমিল্লা নগরীর মানুষ শব্দ দূষণের ক্ষতিতেও আছেন বিপদজনক এক অবস্থায় । কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা পরিমাপ ও ব্যক্তি পর্যায়ে পরীক্ষায় কুমিল্লা নগরীর ৫৫% মানুষের শ্রবণশক্তি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে । যা এসময়ে ঢাকা, সিলেট ও রাজশাহী নগরীর চেয়েও অনেক বেশি। নিয়মিত পথ চলা ও রাস্তার পাশে কর্মরত মানুষ শব্দ ও বায়ু দূষণের ক্ষতিতে ভোগছেন বেশি। অসংখ্য যানবাহন ও উচ্চ শব্দের হর্ণ এবং অন্যান্য ব্যবহৃত যন্ত্রের বিকট শব্দে চরম অস্বস্তিতে আছেন কুমিল্লা নগরবাসী। পানি ও মাটি দূষণের দিক থেকে কুমিল্লার অবস্থা কেমন তার সঠিক তথ্য না জানা গেলেও পলিথিন, প্লাষ্টিক ও অপচনশীল বর্জ্যে ভরপুর অবস্থায় তাও যে ভালো থাকতে পারে না তা নিঃসন্দেহে বলা যায় । ২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নগরীতে লোকসংখ্যা, যানবাহন বৃদ্ধির সঙ্গে কোনো পরিসংখ্যান ও নগর পরিকল্পনা ছাড়াই অগনিত আবাসিক ও বানিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে । এ অবস্থার পাশাপাশি নগর কর্তৃপক্ষের জনবল সংকট ও ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতার অভাব তৈরি হওয়ায় নাগরিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির চেয়ে সমস্যার ব্যাপকতা এবং পরিবেশ বিরুদ্ধ অনাচারে এক জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়েছে এই নগরী ও মানুষের নগর জীবন ।
প্রকৃতির শোভা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ে একসময় কুমিল্লার সুনাম-সুখ্যাতি ছিল সারা দেশব্যাপি । ব্যাংক আর ট্যাংকের শহরের পরিচয়টিও ছিল একারণে যে, ব্যাকিং ব্যবস্থার সূচনায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং শহর ও তার আশপাশে স্বচ্ছ-টলমল পানিতে ভরা অনেক পুকুর ও দিঘীর সহাবস্থান ছিল প্রয়োজনীয়তা ও মানুষের হৃদয়ের আপন আঙ্গীনার মতো । তারসঙ্গে কুমিল্লার বুক জুড়ে অফুরন্ত শ্রোতধারায় বহমান ছিল- গোমতী নদী । ষাটের দশকে নদী ভাঙ্গন ও শহর এলাকার নিরাপত্তায় বাঁধ নির্মাণ করায় গোমতী নদীর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরের ভেতরের দিকে পুরাতন গোমতী নামে পরিচিত হয় । কুমিল্লা সদর ও শহর এলাকা দিয়ে বয়ে গিয়ে দাউদকান্দি হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হওয়া গোমতী নদী- নিঃসন্দেহে মানুষের জীবন ও পরিবেশের বিশুদ্ধতায় প্রকৃতির এক অনন্য অবদান । কিন্ত নদীর মাটি ও বালু বেচাকেনার বাণিজ্য ও দুর্বৃত্তপনায় গোমতী নদীর নাব্যতা যেমন অনেকটাই আর নেই, তেমনি দখল, দূষণে পুরাতন গোমতীও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। কুমিল্লার চারপাশে মেঘনা, গোমতী, তিতাস- এই তিন নদীর কোনো কোনো অংশ শাখা ও উপশাখায় বিস্তৃত হয়ে সমগ্র জেলার সব মানুষদের যেন একসঙ্গে বেঁধে রেখেছেন আপন মমতা ও সম্পর্কের বন্ধনে । লালমাই-ময়নামতি পাহাড় ও পাহাড়ি পরিবেশ কেমন ছিল, কতটা বুক উঁচু করে মানুষের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, তার কোনো কিছুই গত কয়েক প্রজম্মের মানুষের আর জানা নেই । কেননা প্রকৃতির এমন প্রতিটি দান-অবদানই তত্ত্বাবধানের অভাবে বিপন্ন, বিধ্বস্ত ও কিছু মানুষের নির্মমতার শিকারে পরিণত হয়েছে বলে ফুরিয়ে গেছে তার অনেক কিছুই। শুধু অর্থ মূল্যের গাছই নয়, তারসঙ্গে ওষুধি, ফুল, ফল আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে নির্দশন হয়ে নানান জাতের নানা দরকারি সবুজ প্রতিটি গাছের বাতাসে গা দোলানোর মাঝে স্থস্তি, শান্তি, শোভা উপভেগের যেন কোনোই শেষ ছিল না । গাছ-গাছালি ও নদী, পুকুরের সমবেত নিরব পরিবেশে পরিযায়ী ও পরিচিত পাখিদের কলরব আর ছুটাছুটিও দেখা যেত একসময় এই শহরের চারদিকে । এখন এসবের প্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোথাও কোনো কথাও শোনা যায় না, ইট-পাথরের সারি সারি দালানকোঠাই এখন শহর-নগরের সৌন্দর্য্যরে বলা যায় সব কিছু । তা সত্ত্বেও বলতেই হচ্ছে, প্রকৃতির প্রাচুর্য্য ও পরিবেশের বিশুদ্ধতায় মানুষের প্রতিটি জীবন স্বাস্থ্যসম্মত এবং স্বস্তির বসবাস উপযোগী না হলে অন্য সব কিছুও একসময় হয়ে যেতে পারে একেবারে বৃথা । কুমিল্লায় নগর কর্তৃপক্ষ কার্যকর অর্থে তা ভাবলে এবং নগরজন সে ভাবনায় একাত্ম হলে, নগর জীবনের স্বাদ ও সাধ্যের মাঝে হয়তো সংযোগ হতেও পারে।
উন্নয়ন কখনোই কোনো একক বিষয় নয় । সার্বিক অর্থে উন্নয়ন চিন্তা বিবেচিত না হলে- অর্থনীতিক, অবকাঠামো ও জীবনমান উন্নয়নের প্রয়াস আলাদা ভাবে অসম্পূর্ণ ধারণায় পরিনত হয় । অর্থনীতির নিয়মে উন্নয়নের পাঠ-পাঠ্য ও চর্চার ক্ষেত্রে অনেক কিছু নির্দিষ্ট ভাবে থাকলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষিত ও বাস্তবতায় শুধু বই-পুস্তুকের ধারনাকে যথেষ্ট বলা যায় না । কেননা অর্থনীতি ও উন্ন্য়নের ধারণায় প্রকৃতি এবং পরিবেশের গুরুত্ব যেভাবে যতটা থাকার কথা, তা না থাকায় প্রত্যেক মানুষের সুস্থ জীবন ও মানবিক জীবনের ধারণা অনেকটাই উপেক্ষিত হয়েছে । বর্তমান সরকার স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের যে রূপরেখা গ্রহন করেছে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হলে তাতে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার এবং অগ্রাধিকার থাকতেই হবে । তা না হলে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ধারণার মাঝে যেরকম পার্থক্য তৈরি হয়েছে তার পরিবর্তন যেমন হবে না, তেমনি উন্নয়নের সর্বিক সুফল থেকেও বঞ্চিত হবেন দেশের বেশিরভাগ মানুষ । রাজধানী ঢাকা শব্দ ও বায়ু দূষনে শীর্ষে কিংবা কুমিল্লার মানুষ শব্দ দূষণে বেশি ক্ষতির শিকার বলে অন্য জেলার মানুষরা পরিবেশ দূষণের ক্ষতি থেকে মুক্ত আছেন, এমন অবস্থা আজ আর কোথাও নেই । প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে ঋতু বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন সহ পরিবেশের নানা রকম দূষন, জলাবদ্ধতা, যানজট ও অস্বাস্থ্যকর জনবসতি মিলে দেশের সর্বত্র প্রায় সকল মানুষ একভাবে না একভাবে যে দুর্ভোগের জীবন পার করছেন তাকে কোনো ভাবেই স্বস্তি, শান্তির বসবাস বলা যায় না। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন অথবা ক্ষতির কোনো বিষয়কে কোনো নিদিষ্ট জেলা বা অঞ্চল ভিত্তিক আলাদা করে না দেখে সারা দেশের সমস্যাকেই সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বের দিক থেকে গ্রহন করা উচিত । জলবায়ু বা বৈশ্বিক প্রভাবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে যেমন সত্যি, তেমনি দেশের অভ্যন্তরে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনাশী যতসব অপকান্ড চলছে তার ক্ষতি আরো অনেক বেশি । তাই এই দুই দিক থেকেই ক্ষতির পরিমান কমানোর চেষ্টায় সরকারকে এব্যাপারে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা সহ প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিসংখ্যান এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুব প্রয়োজন।

 

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা, কুমিল্লা শাখা।