শুভ নববর্ষ, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাস্তবতা



‘নববর্ষ পয়লা বৈশাখ শুভ হালখাতা
বাঙালির জীবনে আনে নব বারতা।’
বিদায় নিলো আরও একটি দিন, একটি মাস, এমনকি একটি বছর। আবারও শুরু হলো নতুন করে ক্ষণ গণনা করার পালা। নতুন আরেকটি বঙ্গাব্দ হয়ে গেলো শুরু। এই সঙ্গত কারণেই পুরনো বঙ্গাব্দটিকে বিদায় জানিয়ে নতুন বঙ্গাব্দকে করতেই হয়েছে বরণ। জীবন নিত্য গতিশীল। এই গতিশীলতা কিংবা জীবনের প্রয়োজনেই কালের গণনা। এই ক্ষণ গণনাকে ঘিরেই বর্ষপঞ্জি।এতেও নানান বৈচিত্রতা বিদ্যমান বটে। কোনো কোনো বর্ষপঞ্জিতে ‘সৌর’ আবার কোনোটাতে ‘চান্দ্র’ সন লক্ষ্যণীয়। বাঙালি মুসলমানদের জীবনে দুই রকম সনেরই রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। আমাদের বাংলা সন এ ‘চান্দ্রবর্ষ’ এবং ‘সৌরবর্ষ’ উভয়েরই রয়েছে প্রভাব। কিন্তু বড্ড পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আজকাল বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ যেনো পালনের ঘনঘটা। নেহায়েতই ‘উৎসব’ পালনের মওকাতেই আমরা মহাব্যস্ত। কিন্ত এই ‘বাংলা নববর্ষ’ আমরা পেলাম ঠিক কখন থেকে? মোদ্দাকথা এর শুরু কখন? সেই ইতিহাস কি আমরা জানি? জানতে চাই? বাংলা সন প্রবর্তিত হয় ভারতবর্ষে। বাংলা সনের প্রবর্তন করেন ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর, আর এর বিনির্মাতা চিন্তক হলেন ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী। তাদের কি আমরা কদ্যপিও স্মরণ করি-করতে চাই? তবে একজন বাঙালি হিসেবে আমাততেও বিদায়-বরণ’র গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। সেই সঙ্গতেই স্বাগতম নতুন বঙ্গাব্দ। নতুন এই বর্ষে সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষ।
—
বাংলা সনের উৎপত্তি মূলত হিজরী সন থেকে। মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ওরফে মহামতি আকবরের নির্দেশ মোতাবেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী চিন্তক ফতেহ উল্লাহ্ সিরাজী সম্রাটের মসনদে আরোহণ কাল চান্দ্রসন ৯৬৩ হিজরিকে সৌর গণনায় এনে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ তারিখে বাংলা সনের উদ্ভব ঘটান। প্রশাসনিক প্রয়োজন তথা রাজস্ব আদায়ে শৃঙ্খলা বিধানেই সম্রাট আকবর নিয়েছিলেন এই উদ্যোগ। রাজস্বের সাথে ফসলের সম্পর্ক বিদ্যমান। এজন্য বাংলা সন ফসলি সন হিসেবেও অভিহিত হতো। বাংলা সনের উৎপত্তিগত ইতিহাস পর্যালোচনায় ধর্ম, সংস্কৃতি, উৎপাদন ও কৃষক সমাজের প্রসঙ্গ চলে আসে। তাই বাংলা সন আমাদের কাছে এতোটা প্রিয়।
—
নতুন বছর। স্বভাবতভাবেই মানব মনে নতুন আশাবাদ জাগায়। বিগতের ভুল-ভ্রান্তি, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মানুষ তার জীবনকে করতে চায় নবপ্রেরণায় বিকশিত। এই ইতিবাচকতার কারণেই দু:খ-বেদনা-যন্ত্রণার মধ্যেও আমাদের সমাজ টিকে আছে। তবে সমাজ জীবনকে কাঙ্খিত প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে দরকার অতীতের নির্মোহ বিশ্লেষণ। এতে ত্রুটি থাকলে সমৃদ্ধির স্বপ্নপূরণ থেকে যায় অধরা। এক্ষেত্রে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সর্বমহলে আত্মজিজ্ঞাসা।
—
বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক, গ্রামপ্রধান দেশ। অথচ কৃষক সমাজের স্বার্থরক্ষার চেতনা এখানে দুর্বল। শতকরা ৮০ ভাগ গ্রামীণ মানুষের স্বার্থ সংস্কৃতিকে বেশ সুকৌশলেই পাশ কাটিয়ে গুটিকতেক ভোগবাদী মানুষ এই দেশকে প্রগতির কাঙ্খিত পথে নিয়ে যেতে চায়। তাদের বৈশাখ উদযাপনেও বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির আলামত লক্ষণীয়। আবার কট্টরবাদীরা বৈশাখ উদযাপনকে নিছক ধর্মীয় মোড়কে করতে চায় আচ্ছাদিত।তারা অতি তাত্ত্বিকতায় বৈশাখ পালনকে হিন্দুপনা বোঝাতে তৎপর। অথচ একটিবার ইতিহাস ঘেঁটে দেখতেও চায় না। বাংলা সন চালু করলো কে? কোন্ সন থেকে ঘটলো বাংলা সনের উৎপত্তি? এসব যেনো ঢেকেই রাখতে চায়।
—
ছোট্টকাল থেকেই দেখছি পয়লা বৈশাখ পালন। আমি গাঁয়ের সন্তান। আমার জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর নামের পাহাড়ি গণ্ডগ্রামে। সেথায়ও দেখেছি বৈশাখের উৎসবমুখরতা। পাশের গোসাইস্থল আশ্রমে মেলা বসে আজও। গোসাইস্থলের এই মেলাটি প্রায় সাড়ে আটশ’ বছরের ধারাবাহিকতা। মেলা মানে প্রদর্শনী, তাই হতো উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রদর্শনী। এসবের সাথে থাকতো কিছু খেলনা সামগ্রীও। ‘তরমুজ মানেই গোসাইস্থলের মেলা’ এক শিক্ষকের মুখে এই কথা শুনে অজান্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম স্মৃতিবহ সেই কৈশোরে। ক’বছর আগে একটি দৈনিকের বিশেষ সংখ্যায় ‘পয়লা বৈশাখ মানেই গোসাইস্থলের মেলা’ শিরোনামে লিখেছিলাম একটি কলাম। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অনেক মহলের মাঝে বেশ সাড়াও জাগায়। বৈশাখের এমন মেলা বাংলার গ্রাম-শহর-নগরের আবহমান কালেরই ঐতিহ্য। আবার বাজার-বন্দরে পুরো বৈশাখ মাসজুড়েই দেখতাম শুভ হালখাতা উৎসব। চিরায়ত বাংলার এই উৎসবগুলোকে আজ ভোগবাদী আর কট্টরবাদীরা যেনো অনেকটা নিজেদের করায়ত্তেই নিয়ে নিয়েছে!
—
পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ঘটা করে পান্তা-ইলিশ ভোজন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় ময়ূর, পেঁচা, কুমিরসহ নানান পশু পক্ষীর প্রতিকৃতি-মুখোশের সমাহার ঘটানো হয়। এসব মিছিলের রূপ-আবহ গ্রামবাংলার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার সাথেও অমিল। এসবের সাথে মিলে না আমাদের বিশ্বাসেরও, পাওয়া যায় না কোনোই মঙ্গল বা কল্যাণের সন্ধান। সমাজ বিজ্ঞানের ইতিহাসেও বলা আছে, ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন আর অজ্ঞতা- কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ একদা বিভিন্ন পশু পাখিকে পূঁজা করতো। তাদের কাছেই মঙ্গল বা কল্যাণ ভিক্ষা করতো।’ বাংলাদেশের মানুষ বহু আগেই সেই স্তরটি পেরিয়ে এসেছে। তাহলে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে নতুন করে আবারও পেছনের দিকে আহবান করা কেন?
—
পয়লা বৈশাখ আমাদেরকে অনাচারকে দূর করে নতুন অভিযাত্রায় পথ চলার আহ্বান জানায়। যারা বৈশাখের চিরায়ত আহ্বানকে উপলব্ধি করে আমাদের সমাজকে অনাচার-কুসংস্কারমুক্ত করে উন্নয়ন ও আলোকের পথে চলতে সাহায্য করবে, বৈশাখের পতাকা তাদের হাতেই উড্ডীন রইবে। বিষয়টি বৈশাখপ্রেমীরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল। বঙ্গাব্দ উপলক্ষে সবাইকে আরেকবার জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন আর অশেষ শুভ কামনা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু
ই-মেইল : [email protected]
