বাংলাদেশের কৌশলগত উত্থান : ভারতের উদ্বেগ

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পরিচিত “সেভেন সিস্টার্স” নামে, একটি ভূরাজনৈতিক বিস্ময়। এই অঞ্চল ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং তা সংযুক্ত হয়েছে মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি করিডোরের (শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেন নেক’) মাধ্যমে। চীন, বাংলাদেশ, ভুটান ও মিয়ানমার ঘিরে থাকা এই সাতটি রাজ্য ভারতীয় কূটনীতির একটি দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ। অপরদিকে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এই অঞ্চল ঘিরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক ভূখণ্ডে পরিণত হচ্ছে। বিশেষত, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভৌগোলিক অবস্থান ভারতকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
ভারতের উদ্বেগের শিকড় কোথায়? সেভেন সিস্টার্স অঞ্চল বহুদিন ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদ, জাতিগত সংঘাত ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ভুগছে। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসামসহ প্রায় প্রতিটি রাজ্যে রয়েছে স্বাধীনতাপন্থীআন্দোলনের ছাপ। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এই অঞ্চলে ৫ হাজারের বেশি নিরাপত্তা-সম্পর্কিত ঘটনা ঘটেছে (সূত্র: Ministry of Home Affairs, GoI, Annual Reports)।
বিশেষ করে চীন দীর্ঘদিন ধরে অরুণাচল প্রদেশকে নিজের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে। ফলে ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এই অঞ্চলটি। ২০২০ সালে গালওয়ান সংঘর্ষের পর থেকে এই উদ্বেগ বহুগুণে বেড়েছে (সূত্র: BBC, “India-China Border Clash: What We Know About the Deadly Fight”).
বাংলাদেশ: একটি কৌশলগত নিয়ন্ত্রক ভূখণ্ড, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য জীবন রেখা। ভারতের জন্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরাম পর্যন্ত পণ্য, বিদ্যুৎ ও সৈন্য সরবরাহের অন্যতম সহজ পথ বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের অনুরোধে বহু ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে (সূত্র: The Hindu, “India to Use Bangladesh Ports for Northeast Cargo Movement”, 2020)।
তবে এই নির্ভরশীলতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের জন্য শক্তি অর্জনের উপায়। বাংলাদেশের চীনঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি এবং কৌশলগত বিনিয়োগগুলো ভারতের জন্য এক প্রকার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন কক্সবাজারের গভীর সমুদ্র বন্দর, পায়রা ও মংলা বন্দরসহ অবকাঠামোগত অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয় (সূত্র: The Diplomat, “China’s Strategic Port Projects in Bangladesh”, 2022)।
ভারত এটিকে দেখছে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশলের অংশ হিসেবে, যা ভারতকে চীনের ঘেরাটোপে ফেলতে পারে (সূত্র: Council on Foreign Relations, “China’s Maritime Silk Road”).
বেইজিং-ঢাকা সম্পর্ক ও ভারতের কৌশলগত দ্বিধা, চীন শুধু অর্থনৈতিক নয়, এখন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহেও বাংলাদেশের প্রধান অংশীদার। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনে, যা ভারতীয় প্রতিরক্ষা মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করে (সূত্র: Reuters, “Bangladesh Buys Two Chinese Submarines”, 2016)।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে চীনা প্রযুক্তির অস্ত্র ও সরঞ্জামের ব্যবহার ভারতকে কৌশলগতভাবে সতর্ক করেছে। ভারত যদি কখনো চীনের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়ায়, তবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক তাকে কৌশলগতভাবে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।
তবে বাংলাদেশ কোন সামরিক জোটে নেই। বরং “Friendship to all, malice to none” নীতির অনুসারী। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখন ‘ব্যালান্সার’ ভূমিকায়।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা: ভারতের চাপ ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
ভারতের একাংশে বাংলাদেশের উপর চাপ বাড়ানোর কূটনীতি চলছে—যেমন তিস্তা পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, অভিবাসী সমস্যা ইত্যাদি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ চায় শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সংহতি।
তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ চাইলেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি “জিওস্ট্র্যাটেজিক লিভারেজ” ব্যবহার করতে পারে—তা সামরিক নয়, কৌশলগত ও বাণিজ্যিকভাবে।
বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনা ও দায়িত্ব, বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি পথ—একদিকে আন্তর্জাতিক মিত্রদের নিয়ে এক নতুন শক্তির ভিত্তি নির্মাণ, অন্যদিকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ভূ-কৌশলিক অবস্থান বজায় রাখা। উভয়ক্ষেত্রেই কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের পরিপক্বতা অপরিহার্য।
সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ভারতের উদ্বেগ কেবল নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এটি তার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এক বড় ফ্যাক্টর। আর এই অবস্থায় বাংলাদেশের ভূমিকাও আর ‘প্যাসিভ’ নয়। চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র—সবাই এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে। বাংলাদেশ যদি কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা ও স্বাধীনতা বজায় রেখে এই অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারে, তবে ২১ শতকের দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে সে এক সুপরিচিত নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠবে।
তথ্যসূত্র:
Ministry of Home Affairs, Government of India – Annual Reports
BBC News – “India-China Border Clash: What We Know About the Deadly Fight”, 2020
The Hindu – “India to Use Bangladesh Ports for Northeast Cargo Movement”, 2020
The Diplomat – “China’s Strategic Port Projects in Bangladesh”, 2022
Reuters – “Bangladesh Buys Two Chinese Submarines”, 2016
Council on Foreign Relations – “China’s Maritime Silk Road”
