এক ট্রানজিট ভালোবাসার গল্প


মনোয়ার হোসেন রতন।।
সাহেব পাড়া থেকে বেগম পাড়ায়—এ যেন এক সোনালি ডানা মেলে ওড়া ভালোবাসার যাত্রাপথ। এই পথে প্রেম নেই, আছে পরিকল্পিত প্রস্থান; এই পথে আবেগ নেই, আছে নিখুঁত প্রজেক্ট রিপোর্ট। আর সেই রিপোর্টের নাম—দেশপ্রেম!
আমাদের কিছু ‘মহান’ ভাই-বোন এখন বেগম পাড়ায় থাকেন। হাতে কফি, পেছনে সবুজ লন, সামনে ধবধবে ল্যাপটপ, আর সাথে নির্ভার এক জীবন। আর ফেসবুক লাইভে এসে ঘোষণা দেন—
“আমরা দেশের জন্য বাঁচি!”
“আমরা জনগণের পাশে আছি!”
“উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশকে আমরাই ভাসিয়েছি!”
এই ঘোষণার শব্দ যতটা উচ্চকিত, ভেতরের মনোভাব ততটাই নিঃসাড়। কারণ, তাদের সাহেবদের দেশপ্রেম একধরনের ট্রানজিট ভালোবাসা—যার উৎস দেশে, কিন্তু গন্তব্য বিদেশের নিরাপদ কোণে। এই ভালোবাসা রিফাইন করা, সাজানো, এবং সময়সাপেক্ষ। এ ভালোবাসা ঠিক তখনই জেগে ওঠে, যখন দেশ জুড়ে ভোট, চক্রান্ত, ভাগ-বাটোয়ারা কিংবা সম্পদ আহরণের সুযোগ আসে।
তাদের জন্য বাংলাদেশ যেন এক খনিজ ভাণ্ডার—যেখান থেকে যা সম্ভব, টেনে নিয়ে যাও। তারপর নিরুদ্বেগে বিদেশের সাইলেন্ট জোনে গিয়ে ঘুমাও। ওরা জানে, কিছুদিন পর আবার ডাক আসবে—নতুন শো, নতুন নাটক, নতুন স্বপ্ন বিক্রির প্যাকেজ নিয়ে।
তবে এই গল্প শুধু রাজনীতিবিদদের নয়। কিছু পুঁজিপতি, কিছু সুবিধাভোগী, কিছু মুখোশধারী সেলিব্রেটিও এই একই কায়দায় দেশপ্রেমে উদ্বেল হন। এদের ভালোবাসা ছবি তোলে বিদেশি কনফারেন্সে দাঁড়িয়ে, এদের দেশপ্রেম লেখা থাকে বাই লাইন দিয়ে—“From New York/London/Dubai with love for Bangladesh!”
এই ট্রানজিট প্রেমিকদের চোখে দেশের মানুষ হচ্ছে শুধু আবেগের পণ্য—যাদের কান্না, হাসি, রক্ত, ঘাম সবই ব্যবহারের উপযোগী। যখন দরকার, তখন তারা আমাদের মনে করিয়ে দেন—আমরা কতটা অসহায়, কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছি। আর তারাই কতটা দায়িত্ববান! কিন্তু তারা বলেন না, তাদের ছেলেমেয়েরা কেন বিদেশে পড়ে, তাদের টাকা কেন বিদেশি ব্যাংকে থাকে, তাদের চিকিৎসা কেন বিদেশে হয়?
দেশের মাটিতে জন্ম নিয়ে, দেশের মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে যদি দেশকে শুধুই লুটের খনি হিসেবে ভাবা হয়—তবে সে ভালোবাসা আর যাই হোক, নিঃস্বার্থ হতে পারে না। এ এক স্বার্থান্বেষী, সুবিধাবাদী ভালোবাসা—যা ট্রানজিট ভিসার মত, সময় ফুরালেই ফিরে যায় অন্য গন্তব্যে।
তারা ফিরে আসবে—নতুন ব্র্যান্ডিং, নতুন কথা, নতুন শ্লোগান নিয়ে। এবং আমাদের ভুলে যাওয়া, ক্ষমা করে দেয়া, আবার ভালোবাসার প্রবণতা দেখে ওরা আশ্বস্ত হবে। কারণ, এই জাতি দ্রুত ভুলে যায়। যারা গাইত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”—তাদের কণ্ঠেই ধরা পড়ে দেশকে ধোঁকা দেয়ার গোপন সুর।
তবু দেশ দাঁড়িয়ে আছে, এই সব ট্রানজিট ভালোবাসার বিপরীতে কিছু নিরব প্রেমিকের ভরসায়। যারা এখনো পেছনের মেঠোপথে হেঁটে স্কুলে যায়, গরম ভাতের সাথে ডাল খেয়ে অফিসে দৌড়ায়, ভাঙা বাঁশের চাটাইয়ে ঘুমায়, এবং দেশের জন্য সত্যিকার ভালোবাসায় হৃদয় নিংড়িয়ে দেয়। এদের ভালোবাসা ট্রানজিট নয়—স্থায়ী, আত্মত্যাগী, এবং নিরব। এই ভালোবাসায় কণ্ঠে সুর কম, কিন্তু মাটির গন্ধ বেশি।
দেশ একদিন ঠিক চিনে নেবে—কারা সত্যিকারের প্রেমিক, আর কারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার। ইতিহাস সব মনে রাখে—কখনো কবিতায়, কখনো খবরে, কখনো শোক
গাথায়। আর সেই ইতিহাসের পাতায়, একদিন লেখা হবে—“তারা এসেছিল, নিয়েছিল, আবার চলে গিয়েছিল… কিন্তু দেশ রয়ে গেছে, তাদের ছেঁড়া চাদরের নিচেই।”
এ দেশ কারো পৈতৃক জমিদারির জায়গা নয়। এ দেশের মাটি, জল, বাতাস, ঘাম ও রক্ত—যারা বুকের ভেতর ধারণ করে, তারাই এই দেশের প্রকৃত প্রেমিক। বাকিরা? তারা শুধু এক ট্রানজিট ভালোবাসার গল্প। একটি পাতা—যা ইতিহাসের ঝড়ে উড়ে যায়।