সব দায়িত্ব কেন আওয়ামী আমলাদের দিতে হবে?

তৈয়বুর রহমান সোহেল ।।
১ আগস্ট শুক্রবার। জুমার নামাজ আদায় করতে ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রি শাখা জামে মসজিদে যাই। ইমাম বাংলা খুতবা আলোচনা করছেন। খুতবার শেষ দিকে আগত মুসল্লিদের কাছে একটি অনুযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এই কলেজে ২০০২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইমামতি করেছি। মাঝে বিরতি দিই। চলতি বছর আবার শুরু করি। কারও সঙ্গে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, এই ছেলে নিয়মিত আমাকে ডিস্টার্ব করছে। এ কথা শোনার পর ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। প্রথমে নিজের পরিচয় দেয়। তারপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে জোর গলায় ইমামকে মিথ্যাবাদী বানানোর চেষ্টা করে। প্রথমে অনেকে নিশ্চুপ। একজন মুসল্লি বলে ওঠেন, তুমি হাতুড়ি নিয়ে ইমামের বাসার সামনে ঘোরাঘুরি করো, কারণ কি? অপর আরেকজন বলেন, তোমাকে বারবার সাবধান করেছি। আরেকজন বলেন, তুমি আমার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছ। সে সব অভিযোগ অস্বীকার করে তর্ক চালায়। এরই মাঝে ইমাম কাবলাল জুমার আহ্বান করেন।
৫ আগস্ট বাংলাদেশের গতিপথ বদলে দিয়েছে। মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। পরিবর্তনের স্বপ্ন যেন বাস্তবে ধরা দিয়েছে। কিন্তু না! সেই স্বপ্ন এখনো অধরা। মসজিদে বিশৃঙ্খলা করা ছেলেটির বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগের পরও শত শত মুসল্লির মধ্যে মাত্র তিনজন প্রতিবাদ করেছেন। বাকিরা চুপ। মনে ভয়। বোঝাই যাচ্ছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এমন দুঃসাহস দেখাচ্ছে ছেলেটি। জুলাই বিপ্লবের পর এই চক্রগুলো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা বিরল।
আরেকটি ঘটনা। একদিন কুমিল্লার এক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে উঠে আসল, জুলাই বিপ্লব দমনে শত-শত অস্ত্রধারীকে দেখা গেছে। কুমিল্লায় গ্রেপ্তারের পরিমাণ কম কেন? এই অস্ত্রধারীরা কোথায়? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, আগে একজনকে আটক করলে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের লোকজন ছুটিয়ে নিতে আসত। এখন বিএনপি, জামাত, এনসিপিসহ সবাই থানায় এসে বলে, উনি আমাদের লোক! তাদবিরবাজদের কারণে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেগ পেতে হয়। বুঝতেই পারছেন, গ্রেপ্তার কম থাকার কারণ।
৫ আগস্টের পূর্বে সেনাবাহিনীতে বিভাজনের রেখা পড়ে। সৈনিকেরা আপামর জনতার পক্ষ নেয়। কিছু অফিসার স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি চায়। ৪ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে কোনো কোনো স্থানে ফাঁকা গুলি ছোড়ে সেনাবাহিনী। মানুষ স্লোগান তোলে, এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনী সরকার। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ক্রমাগত চাপ বাড়ে। ৫ আগস্ট হাসিনা পালায়। ৮ আগস্ট সকলের অনুরোধে দেশের দায়িত্বভার নেন নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড. ইউনূস। মানুষের আশা বাড়তে থাকে। কেউ হয়ে পড়েন অতিউৎসাহী। প্রতিদিন দাবিদাওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধ, আন্দোলন। পলাতকরা নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সমন্বয়কসহ রাজনৈতিক দলের অনেকে চাঁদাবাজিসহ বিপুল অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা মাসের পর মাস বাড়ানো হয়। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। বলা হয়, পুলিশের মোরালিটি ভেঙে গেছে। হাতিয়ে দেখি, আগের চেয়ে ঘুষ একটু বেশিই নিচ্ছেন তারা!
কুমিল্লার কোনো এক পৌরসভার সাবেক মেয়র। নিজের নামটা কোনোমতে শিখেছিলেন। পড়াশোনা জিরো। গত সাড়ে ১৫ বছরে তিনি হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন। এতে মানুষের হাতে-পায়ে ধরতে হয়েছে। অনেক নিচে নামতে হয়েছে তাকে। ওই উপজেলার বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা কোনো কাজে ২০ শতাংশ কমিশন নেন। তিনি একসঙ্গে পৌর ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসক। আবার শুনলাম সরকার তাদের মসজিদ কমিটির সভাপতিও বানাচ্ছেন। তিনি এক বছরেই লুটপাটে ছক্কা মেরে দিয়েছেন। দেশে এত কর্মজীবী থাকতে সব দায়িত্ব কেন সেই আওয়ামী পন্থী আমলাদের দিতে হবে, তা ভেবে কূল পাই না।
ফেসবুকে সাধারণ পোস্ট করেও স্বস্তি নেই। হাসিনা সমর্থকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। সরকারে তাকালে দেখি, ইউনিয়ন পরিষদের সচিব থেকে মন্ত্রণালয়ের সচিব, সব আওয়ামী লীগের লোকজন দিয়ে ভরা। এমনকি উদ্যোক্তা, মাস্টার রোল কর্মচারী পর্যন্ত আওয়ামী লীগের লোকজনে ঠাঁসা। বাইরে তাকালে দেখি দখল আর চাঁদাবাজিতে লিপ্ত বেশকটি দল। এসবের জন্য জুলাই বিপ্লব হয়নি। এই দেশ রক্ত দিয়ে কেনা। মানুষের মনে অনেক স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন কাচের দেয়ালে কাটা পড়তে পারে না।

inside post

লেখক: সংবাদকর্মী।

আরো পড়ুন