হরমুজ প্রণালী:আধুনিক বিশ্ব রাজনীতির বিস্ফোরণভূমি


মনোয়ার হোসেন রতন।।
হরমুজ প্রণালী—মাত্র ২১ মাইল চওড়া এক সংকীর্ণ জলপথ, কিন্তু এর কৌশলগত গুরুত্ব এতটাই গভীর যে, এটিকে বিশ্ব অর্থনীতির ‘শ্বাসনালী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বৈশ্বিক জ্বালানি চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ। ফলে এই জলপথে উত্তেজনার সামান্য ঢেউও বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক ভূকম্পন তৈরি করতে পারে।
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম উত্তপ্ত অঞ্চল এখন এই হরমুজ প্রণালী। ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘর্ষ, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং চীনের কৌশলগত উদ্বেগ—সব কিছু মিলিয়ে এই প্রণালী আজ কেবল একটি বাণিজ্যপথ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে যুদ্ধ ও শান্তির সন্ধিক্ষণ।
ইরান যেভাবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধে সরাসরি অংশ নিচ্ছে, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অন্যান্য সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক মহাসংকেত। অন্যদিকে, ইসরায়েল একের পর এক সামরিক ও সাইবার হামলা চালিয়ে ইরানকে উসকে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় হরমুজ প্রণালী হয়ে উঠেছে অস্তিত্ব রক্ষার এক লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।
যুক্তরাষ্ট্র: শত্রু ঘেরাও নাকি শান্তির বার্তা?
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির বিস্তার এখন আর কৌশল নয়, তা এক দখলদারিত্বের বার্তাও। কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, সৌদি আরব, এমনকি ওমানেও রয়েছে মার্কিন উপস্থিতি। “Containment Doctrine” বা নিয়ন্ত্রণনীতি অনুসারে ইরানকে ঘিরে রাখা হয়েছে যেন হরমুজ প্রণালীর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়। মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, ড্রোন, এবং এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার প্রণালীজুড়ে টহল দিচ্ছে। এ যেন তেল নয়, আগুনের রুট।
যদি হরমুজ বন্ধ হয়ে যায়?
বিশ্ব তেলবাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি হবে। তেলের দাম দ্বিগুণ বা ততোধিক বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে, খাদ্য সংকট দেখা দেবে। দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ ও চীনের শিল্প উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়বে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এই বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকবে না।
এই বিপর্যয়ের মাঝেই যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলো হয়তো “তেলের নিরাপত্তা” রক্ষার নামে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। তখন হরমুজ প্রণালী হয়ে উঠবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাব্য সূচনাস্থল।
চীনের শান্তিপূর্ণ কৌশল
বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক চীন। তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সরাসরি নির্ভর করে হরমুজ প্রণালীর নিরাপদ ব্যবহারের ওপর। তাই একদিকে চীন ইরানের সঙ্গে কৌশলগত চুক্তি করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। চীনের বার্তা সরল—“প্রণালী বন্ধ করো না, বিশ্ব অর্থনীতি বন্ধ হয়ে যাবে।”
হরমুজ: কেবল প্রণালী নয়, এক ফুসফুস
এই সংকীর্ণ জলপথ যেন আজ আধুনিক অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। দক্ষিণ এশিয়ার কারখানা, ইউরোপের জ্বালানি চাহিদা, চীনের কলকারখানা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প—সব কিছু এক সুতোয় গাঁথা, যার নাম হরমুজ প্রণালী।
সিদ্ধান্তের মুহূর্ত: যুদ্ধ না শান্তি?
বিশ্ব আজ দাঁড়িয়ে আছে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে—যেখানে হরমুজ প্রণালীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো মানবজাতির ভবিষ্যৎও। প্রশ্ন একটাই—এই সংকীর্ণ পথে কি প্রবাহিত হবে রক্ত, নাকি তেল? সিদ্ধান্ত নিতে হবে: সামরিক আধিপত্য, নাকি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা?
হরমুজ এখন শুধু কৌশলগত মানচিত্র নয়—এটি একটি বিস্ফোরণভূমি, যেখানে দখল আর মুক্তির, অস্ত্র আর অর্থনীতির, যুদ্ধ আর মানবতার ভয়াবহ দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত ছায়া ফেলছে আমাদের ভবিষ্যতের ওপর।
এখন সময়, হরমুজ প্রণালীতে গর্জে উঠুক যুদ্ধজাহাজ নয়—মানবতার কণ্ঠস্বর।