১০০ বছরের ঐতিহ্যের ঠাণ্ডা কালিবাড়ি মেলা

ঈদ-পার্বণের পর কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মানুষের মধ্যে  সবচেয়ে বড় উৎসব কাজ করতো ঠাণ্ডা কালিবাড়ি মেলাকে ঘিরে। উপজেলার হাসানপুর রেললাইন লাগোয়া এ মেলায় সমাগম ঘটতো কয়েকলাখ মানুষের। শুধু নাঙ্গলকোট উপজেলা নয়, কুমিল্লার অন্যান্য উপজেলা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর জেলার মানুষেরও ব্যাপক উপিস্থিতি থাকতো এ মেলায়।  মাঘ মাসের ১ তারিখ মেলাটি অনুষ্ঠিত হতো।
মেলাকে উপলক্ষ করে হাসানপুর, ঢালুয়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষ মাটিরঘর ও কাঁচাঘর লেপ দিতো। বাড়িকে সাজানো হতো পরিপাটি করে। মেলার দিন মেয়ে, মেয়ে জামাই ও আত্মীয়স্বজনদের উপস্থিতি অনেকটাই বাধ্যতামূলক ছিল। জামাই আদরের জন্য বড় বড় সামুদ্রিক মাছ, রুই-কাতলা-মৃগেল-বোয়াল কিনে নিতেন শ্বশুররা। শুধু মেলারস্থল নয়, আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে মিনি মেলা বসে যেতো। ঘর থেকে বের হলে মানবস্রোত দেখা যেতো। সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে গ্রামের আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সবাই পৌঁছে যেতো মেলায়।  দুই-তিন ঘণ্টা হাঁটলেও আড্ডা-গল্পের ছলে কেউ ক্লান্তি অনুভব করতেন না। মেলায় বড় বড় মাছ ছাড়াও ঘোড়ার দৌড়সহ নানারকম খেলার আয়োজন থাকতো। খেলনা, মণ্ডামিঠাই, আচারের পসরা বসতো সেখানে।
আজ সেই মেলার দিন। কিন্তু করোনাে প্রকোপের কারণে গতবারের ন্যায় এবছরও মেলাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। মাঝে করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় মেলার প্রস্তুতিও চলে জোরেশোরে। ওমিক্রনের বিস্তারের কারণে শেষ পর্যন্ত মেলার ইজারা ডাকা হয়নি। এদিকে গত ১৩ জানুয়ারি মেলাকে উপলক্ষ করে মৌকরার বিরুলিয়া গ্রামে হিলিয়াম বেলুন ফোলানোর সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়ে ৪১জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী জানা যায়, আহত ১৫ জন এখনো হাসপাতালে ভর্তি। যাদের মধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে নয়জনকে। সেখানে একজন আইসিইউতে আছেন। বাকিরা চিকিৎসা নিচ্ছেন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মেলায় অংশ নিতে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে ওইদিন দুই শিশু স্প্লিণ্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়।
মেলা নিয়ে বেদনা হয়তো আছে, তারপরও উৎসব ধরে রাখতে নাঙ্গলকোটের বাজারগুলোতে মিলি মেলা বসানো হয়েছে। শনিবার সকালে নাঙ্গলকোটের কোচপাড়া, বটতলী, ঢালুয়া ও মিয়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খেলনা, জিলাপি, তিলের খাজা, বাতাসা ও মাছের দোকান বসেছে। সকালে ওই অন্য দোকানগুলোয় ভিড় না থাকলেও মাছের আড়তে ভিড় দেখা গেছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ শাজাহানের বাড়িও নাঙ্গলকোটের গোত্রশালে। তিনি জানান, ছোট বেলায় প্রতি বছরই ঠাণ্ডা কালিবাড়ি মেলায় যেতাম। শৈশবের আবেগ জড়িত আছে মেলাটিকে ঘিরে। মেলার দিন উৎসবের মাতম বয়ে যেত। বাবা-ছোট ভাইসহ হেঁটে হেঁটে মেলায় চলে যেতাম।
নাঙ্গলকোটের কাশিপুরের প্রবীণ বাসিন্দা আলী আক্কাছ জানান, ঠাণ্ডা কালিবাড়ি মেলার জন্য সারা বছর অধীর আগ্রহে থাকতাম। খুব সকালে নিজে গিয়ে বড় মাছ নিয়ে আসতাম। দুপুর বেলা বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে আবার যেতাম। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করতো তখন।
মৌকরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন জানান, মেলা যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে কালিবাড়ি ও কালিমন্দির ছিল। মাঘ মাসের এক তারিখ ঠাণ্ডার সময় এবং কালিবাড়ির নাম সংযুক্ত করে এর নাম হয়েছে ঠাণ্ডা কালিবাড়ি মেলা। একশ বছরের বেশি সময় ধরে এ স্থানে মেলাটি বসে। এবারসহ দুই বছর করোনার কারণে মেলার ডাক নেওয়া হয়নি।
inside post
আরো পড়ুন