“রোজার ঐতিহাসিক তাৎপর্য”

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।।
রোজা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। আদি কাল থেকেই রোজা মানুষের আত্মশুদ্ধির পথ হিসেবে প্রচলন আছে।যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন-”হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতীর্দের ওপর,যাতে তোমরা  মুত্তাকী হতে পারো।” এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,রোজা পূর্ববর্তী যুগেও ফরজ ছিল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রোজার তাৎপর্য  নিম্নে তুলে ধরা হলো – হযরত আদম (আঃ)-এর যুগে রোজা পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম কে  রেখেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে হযরত খিযির ইবনে হুবাইশ (রহঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- আইয়্যামে বীজ কি? উত্তরে তিনি বললেন-আল্লাহ পাকের নিষিদ্ধ ফল খেয়ে হযরত আদম (আঃ) জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরিত হন এবং তাঁর দেহের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। তাঁর এই দুর্দশায় ফেরেশতাগণ আল্লাহর সমীপে কান্নাকাটি করে হযরত আদম (আঃ)-এর মুক্তি কামনা করেন। ফলে আল্লাহ পাক হযরত আদম (আঃ)-এর নিকট এই মর্মে ওহী পাঠালেন যে, আপনি চন্দ্রমাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোজা রাখুন। হযরত আদম (আঃ) তা-ই করলেন। ফলে তাঁর দেহের রং আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
একারনে এই তিনটি আইয়্যামে বীজ বা উজ্জ্বল দিন বলা হয়। * হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে রোজা হাদিস শরীফে হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে রোজার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত রাসুল (সাঃ) ইশরাদ করেন- “ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ছাড়া হযরত নূহ (আঃ) সারা বছর রোজা রাখতেন।” (ইবনে মাজাহ্ ) তাফসীরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ আছে, হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে প্রতিমাসে তিনদিন রোজা রাখার হুকুম ছিল। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। শুরুতে মুসলমানগণও মাসে তিন দিন রোজা রাখতেন
মাহে রমজানের একমাস রোজা পালনের হুকুম সম্বলিত আয়াত নাযিল হলে, তা রহিত হয়ে যায়।(তাফসীরে ইবনে কাসীর) * হযরত মুসা (আঃ)-এর যুগে রোজা * হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিজরত করে মদীনায় আগমণ করার পর দেখলেন যে, ইয়াহুদীরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- এটি কি ধরনের রোজা ? জবাবে তারা বলল, এটি আমাদের জন্য একটি পবিত্র দিন। এদিনে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর দুশমন ফির’আউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে হত্যা করে বনী ইসরাঈলকে নাজাত দিয়েছেন। তাই এ দিনে শুকরিয়া স্বরূপ হযরত মুসা (আঃ) রোজা রাখতেন।(বোখারী শরীফ) এ হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয় যে, হযরত মুসা (আঃ)-এর যুগেও রোজা ছিল এবং সে ধারা বনি ইসরাইল ও ইয়াহুদীদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগ পর্যন্ত বজায় ছিল। * হযরত দাউদ (আঃ)-এর যুগে রোজা ইমাম বোখারী (রহঃ) একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) কে নবী করীম (সাঃ) বললেন-”তুমি হযরত দাউদ (আঃ)-এর অনুরূপ রোজা রাখ। তিনি [হযরত দাউদ (আঃ)] একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিরতি দিতেন।” (বোখারী শরীফ) * হযরত দাউদ (আঃ)-এর যুগে রোজা * হযরত দাউদ (আঃ)-এর জন্মের সময় কৌতুহলী জনতা তাঁর মাতা মারইয়ামকে তাঁর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে থাকলে, উত্তরে তিনি বললেন -”আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশ্যে মান্নত করে রোজা রেখেছি। সুতরাং আমি কোন কিছুতেই কোন মানুষের সঙ্গে বাক্যলাপ করবো না। “ (সুরাহ্ মারইয়াম,২৬) জাহেলী যুগে কুরাইশ ও মুশরিকদের রোজা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-’জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশূরার দিনে রোজা রাখত।’ (বোখারী শরীফ) সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে,রমজানের একমাস সিয়াম সাধনা নির্দিষ্ট হবার পূর্বে বিশ্বের সকল জাতিই কম-বেশি রোজার সাথে পরিচিত। ** ইসলামের রোজাঃ  ইসলামী শরীয়তে রমজানের রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরী সনের শা’বান মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এর পূর্বে মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ ছিল কি-না, এব্যাপারে মতভেদ আছে ।
কারো কারো মতে, রমজানের পূর্বে কোন রোজা ফরজ ছিল না। আবার কারো কারো মতে, আশুরার রোজা ফরজ ছিল। আবার কারো কারো মতে,আইয়্যামে বীজের রোজা ফরজ ছিল। পরবর্তীতে রমজানের বিধান অবতীর্নের পর তা রহিত হয়ে যায়। ইসলামের সেই প্রাথমিক রোজার সময়ে নিয়ম ছিল যে, সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করার সময় থেকে নিয়ে ঘুমাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্বামী-স্ত্রী সহবাস করা যাবে। কিন্তু রাতে একবার ঘুমিয়ে পড়লে, তার জন্য সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যেত। এতে অনেক সাহাবী (রাঃ) নানা রকম অসুধিবার সম্মুখীন হন। সাহাবায়ে কেরামের এসব সমস্যার সমাধানকল্পে আল্লাহ তা’য়ালা আয়াত নাযিল করেন-”তোমাদের জন্য রমজানের রাতে স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে——- আর খাও এবং পান কর, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা (সুবেহ সাদিক) তোমাদের নিকট পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।” (সুরাহ্ বাকারা, আয়াত ১৮৭) আবার শুরু যামানায় রোজা না রেখে ফিদইয়া দেয়ার অনুমতিও ছিল। পরে তা রহিত হয়ে যায়। তবে অতি বৃদ্ধ (যারা রোজা রাখতে অক্ষম) এবং চিররুগ্ন ব্যক্তির জন্য এ বিধান এখনো বহাল আছে। তারা প্রতিটি রোজার জন্য একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে দু’বেলা পেট ভরে তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াবেন অথবা সদকায়ে ফিতর পরিমান খাদ্যদ্রব্য বা টাকা দান করবেন। উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে,রোজার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনেক। আমাদের সৌভাগ্য যে,আমাদের জন্যই একমাস ব্যাপী রোজা ফরজ করা হয়েছে। মাহে রমজান মাসের প্রতিটি ফরজ অন্য যে কোন মাসের ৭০টি ফরজের সমান। রোজা আমাদের জন্য রহমত,মাগফেরাত, এবং নাজাত’ এর সুসংবাদ নিয়ে হাজির। আমরা যেন,রোজার হক যথাযথ ভাবে আদায় করতে পারি এই কামনাই করি। আল্লাহ আমাদের রমজানের পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন, আমিন।