জুমার দিন সুরা কাহফ পড়ার ফজিলত
আমোদ ডেস্ক।।
১. সুরা আল কাহাফ
পবিত্র কোরআনের ১৮তম সুরা। কাহাফ মানে গুহা। এ সুরার আয়াত সংখ্যা ১১০। জুমাবারে সুরা আল কাহাফ পড়তে বলা হয়েছে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) রাসুল (সা.)–এর পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ পাঠ করবে, তার জন্য এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত নূর বর্ষিত হবে।’ এ সুরায় চারটি ঘটনা, চারটি বক্তব্য ও উপদেশ রয়েছে।
সুরার ১ থেকে ৮ আয়াতে রয়েছে বক্তব্য। ৯ থেকে ২৬ আয়াতে আছে আসহাবে কাহাফের ঘটনা। ২৭ থেকে ৩১ আয়াতে আবার বক্তব্য এসেছে। ৩২ থেকে ৪৪ আয়াতে দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা রয়েছে। এরপর আবার লম্বা বক্তব্য ও উপদেশ এসেছে ৪৫ থেকে ৫৯ আয়াতে।
এ সুরায় দুটি কাহিনি এসেছে ৬০ থেকে ১০১ আয়াতে। সে দুটি হলো মুসা (আ.) এবং খিজির (আ.) জ্ঞানীর ঘটনা ও জুলকারনাইন–সম্পর্কিত ঘটনা। আবার সুরা শেষ হয়েছে বক্তব্য ও উপদেশ দিয়ে।
২. দুইটি বাগানের মালিকের ঘটনা
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের এ সুরায় দ্বিতীয় একটি শিক্ষণীয় ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلًا رَّجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا
‘আপনি তাদের কাছে দুই ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে দুটি আঙ্গুরের বাগান দিয়েছি এবং এ দুইটিকে খেজুরে গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি এবং দুয়ের মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩২)
শিক্ষা : সম্পদের উপর পরীক্ষা
এভাবে এ সুরার ৩২-৪৬ আয়াত পর্যন্ত দুনিয়ার ধন-সম্পদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুন্দর শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরেছেন। আল্লাহ দুইটি প্রাচুর্যময় সুন্দর বাগান দিয়ে ধন্য করেছিলেন, কিন্তু লোকটি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে গেল; এমনকি পরকালের অস্তিত্ব সম্পর্কে আল্লাহর ওয়াদার উপর সন্দেহ পোষণ করলো। কাজেই, এই অকৃতজ্ঞ লোকটির বাগানকে আল্লাহ তাআলা বিরান করে দিলেন। তারপর সে অনুতপ্ত হল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং তার এই অসময়ের অনুশোচনা তার কোনো উপকারে আসেনি।
৩. খিজির ও মুসা আলাইহি সালামের ঘটনা
যখন মুসা আলাইহি সালামের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে?’ তিনি উত্তর করেছিলেন, ‘আমি’। কিন্তু আল্লাহ তাঁর কাছে উন্মোচন করে দিলেন যে, এমন এক ব্যক্তি আছেন; যাকে আল্লাহ তাঁর চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছেন। সে ঘটনা এ সুরার ৬০নং আয়াত থেকে শুরু হয়েছে।
মুসা আলাইহি সালাম সেই ব্যক্তির সঙ্গে ভ্রমণ করলেন এবং দেখলেন, শিখলেন কিভাবে অনেক সময় আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞানের কারণে এমন অনেক ঘটনা ঘটান যেগুলো আমাদের চোখে খারাপ বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেগুলো মানুষের ভালোর জন্যই করা হয়। আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামের এ ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-
فَوَجَدَا عَبْدًا مِّنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِندِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِن لَّدُنَّا عِلْمًا
‘তারপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৬৫)
শিক্ষা : জ্ঞানের উপর পরীক্ষা
হজরত মুসা আলাইহিস সালাম হজরত খিজির আলাইহিস সালামের সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করে বুঝলেন মহান আল্লাহর এমন অনেক বান্দা আছেন যাদের মহান আল্লাহ অনেক জ্ঞান দিয়েছেন। দাজ্জালও মানুষের সামনে সমৃদ্ধ অনেক জ্ঞানের কথা তুলে ধরে তার আধিপত্য বিস্তারে চেষ্টা করবে। এ ঘটনায় ঈমানদারদের জন্য রয়েছে দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্তির উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পাওয়ার উপায়।
৪. বাদশাহ যুলকারনাইনের ঘটনা
ক্ষমতাধর বাদশাহ যুলকারনাইন। তিনি সেই ক্ষমতাধর বাদশাহ; যাকে একই সঙ্গে জ্ঞান এবং ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল এবং তিনি সেই উভয় দানের শুকরিয়া আদায়ে সব সময় মানুষের উপকারে এবং কল্যাণে তা ব্যয় করতেন। তিনি জনপদের লোকদের ইয়াজুজ মাজুজ এর সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন আর নির্মাণ করেছিলেন একটি বিশাল প্রাচীর। আল্লাহ তাআলা এ ঘটনা এভাবে শুরু করেন-
وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا
‘তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। (আপনি) বলুন, আমি তোমাদের কাছে তাঁর কিছু অবস্থা বর্ণনা করব।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৮৩)
إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآتَيْنَاهُ مِن كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا
‘আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৮৪)
এ সুরার ৯৮নং আয়াত পর্যন্ত বাদশাহ জুলকারনাইনের ঘটনার বর্ণনা স্থান পেয়েছে। যেখানে মানুষের কল্যাণে এবং ইয়াজুজ-মাজুজের ঘটনাও তাতে ওঠে এসেছে।
শিক্ষা : ক্ষমতার উপর পরীক্ষা
দাজ্জাল পৃথিবীতে এসে তার ক্ষমতা দেখাবে। ঈমানদার বান্দার জন্য তখন বাদশাহ যুলকারনাইনের ঘটনা হবে অনুপ্রেরণা। কোনো ক্ষমতার দম্ভ তাদের ঈমানহারা করতে পারবে। এ কারণেই জুমআর দিন মুমিন বান্দার ঈমান দৃঢ় করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা কাহফ পড়ার উপদেশ দিয়েছেন। আর এভাবেই ঈমানদার বান্দা দাজ্জালের ফেতনা থেকেও মুক্তি পাবেন।
সুরা কাহফ তেলাওয়াতের ফজিলত
১. হজরত সাহাল ইবনে মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম ও শেষ আয়াতগুলো পাঠ করবে; তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটি নূর হয়ে যায়। আর যে পূর্ণ সুরা তেলাওয়াত করে তার জন্য জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত নূর হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ)
২. হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, যে সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করবে; সে দাজ্জালের ফিৎনা হতে নিরাপদ থাকবে। অন্য হাদিসে ভিন্ন রেওয়ায়েতে শেষ ১০ আয়াতের ব্যাপারে উল্লিখিত ফজিলতের বর্ণনা রয়েছে। (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদ)
সুতরাং প্রথম বা শেষ ১০ আয়াত অথবা উভয় দিক দিয়ে মোট ২০ আয়াত যে মুখস্ত করবে সেও হাদিসের ঘোষিত ফজিলত লাভের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
জুমার দিনের তেলাওয়াত
১. হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য এক জুমা থেকে অপর (পরবর্তী) জুমা পর্যন্ত নূর হবে।
২. হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করবে, সে আটদিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফিৎনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে সে দাজ্জালের ফিৎনা থেকেও মুক্ত থাকবে।
৩. অন্য রেওয়ায়েতে আছে এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তবে উল্লিখিত গুনাহ মাফ হওয়ার দ্বারা সগিরা গুনাহ উদ্দেশ্য। কারণ ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য হচ্ছে যে, কবিরা গুনাহ তওবা করা ছাড়া ক্ষমা হয় না।
মনে রাখতে হবে
জুমার দিনে যে সুরা কাহফ তেলাওয়াত করবে তার নূর এক জুমাহ থেকে অন্য জুমাহ পর্যন্ত আলোকজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এ উজ্জ্বলতা তার কলবে হবে, না হয় তার কবরে হবে, অথবা তার হাশরে হবে। এ নূর কি ঐ সুরার নূর নাকি তা সওয়াবের নূর?
কেউ বলেছেন, হেদায়েতের নূর এবং ঈমানের নূর। হেদায়েতের নূর হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা শাওকানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
‘এক জুমাহ থেকে অন্য জুমাহ পর্যন্ত নূর বা আলোকদানের অর্থ হলো, এ দীর্ঘ সময় তার কেরাতের প্রভাব সে পাবে এবং এ এক সপ্তাহ পর্যন্ত তার সওয়াব সে পেতে থাকবে।’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিন সুরা কাহফের আমল, তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন করার মাধ্যমে হাদিসে বর্ণিত ফজিলতগুলো অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।