শৈশবে আঁকা স্মৃতি!

inside post
।। ইলিয়াস হোসাইন।।
১.
বর্ষাকাল! চারদিকে শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি! বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া আঁকা-বাঁকা সরু খাল।খালের দু’পাড়ে বাতাসের কথায় সবুজ ঘাসের মাথা দোলে।
মাছ ধরতে যাচ্ছি বাবার সাথে।বাবার একহাতে ফাই জাল, আরেক হাতে ছাতা দিয়ে আগলে রেখেছে আমার মাথা-যাতে কোনো রকম না ভিজে যাই;কিন্তু বাবা ঠিকই ভিজে যাচ্ছে!
কর্দমাক্ত মেঠোপথ! মাছের ডুলা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে বাবার ভেজা শার্ট শক্ত মুঠে জড়িয়ে ধরে হাঁটছি।আমাদের পাশের ছোট একটি সবুজে ঢাকা গ্রাম ভদ্রাপাড়।এর দক্ষিণ মোড়ে অনেকক্ষণ মাছ  ধরছি। প্রায় ডুলাভর্তি মাছ পেয়েছি।এতো মাছ পেয়ে আমি ভীষণ খুশি।হঠাৎ বাবার দিকে নজর দিয়ে দেখলাম,বাবার শরীর সাদা হয়ে এসেছে।ঠান্ডায় কাঁপছে।শৈশবে বাবার সাদা হয়ে আসা শরীর,কাঁপা শরীরের অর্থ কিছুই বুঝতামনা!কিন্তু এখন গভীরেই বুঝি!ফেরার পথে বাবা ঠিক আগের মতো আমার মাথায় ছাতা ধরে হাঁটছে।বৃষ্টির ঝড় হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে নিজে ভিজে যাচ্ছে,তবুও আমাকে উষ্ণতায় আগলে রেখেছে।আমি বাবার ভেজা শরীর দু’হাতে ভীষণ চেপে ধরে হাঁটছি;বাবার শরীর থেকে অন্যরকম এক ভেজা ঘ্রাণ আমার শরীর জুড়ে মেখেছে।সেই ঘ্রাণ চোখ বন্ধ করলে-আমার নাকে এখনো টের পাই। শৈশবে বাবাকে না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝি -বাবারা হয়তো এমনই।তারা সন্তানকে উষ্ণতায় আগলে রেখে, তীব্র ঠান্ডাতেও নিজেরা ভিজে যায়।এখন আমিও একজন- বাবা!
২.
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে ছোট শাপলার বিল আছে।আমরা একে বলি জলা।পুরো জলা জুড়েই সাদা শাপলা ফুটে থাকতো।ছোটবেলায় দেখতাম অনেকে নৌকো দিয়ে শাপলা তুলতো।কেহ ডুব মেরে তুলতো শালুক। পান কুড়ি মাথা ডুবিয়ে মাছ গিলতো,সাদা বকের দল ঝাপটাতো ডানা।কোমর পানিতে কিশোর-কিশোরীর দল পাতিল ভাসিয়ে দু’হাত হাতিয়ে মাছ ধরতো।প্রতিটি দলে ৮-১০জন  ছিলো। মুখে থাকতো সবার মাছ ধরার সংগীত-‘পুঁটি ল,পুঁটা ল,আমার গাঁথায় আয় ল’।(অর্থ্যাৎ হে পুঁটি মাছ, পুঁটা মাছ সব ধরনের মাছ আমার গর্তে এসে জমা হও।)এই সংগীত চরণটুকুতে সবাই জোশ পেতো,দু’পায়ের মাঝখানে হাতের বাটিতে টানা জলের স্রোতে মাছ পুরে থাকতো সবার দু’পায়ের গোড়ার মাঝখানে করা গর্তে। এই শৈশব স্মৃতি এখন পুরোটাই বিলুপ্ত! দুই যুগ পর এসে সেই সুখকর চিত্র এখন আর দেখা যায় না।কারণ সেই জলা এখন দিন দিন বাড়ি-ঘরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
৩.
মেছের বিছানা গুছিয়ে হঠাৎ বাড়িতে যাবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তখন দিনের আলো নিভে সন্ধ্যার বাতি জ্বলছে।আকাশে ঘনঘটা রঙিন মেঘ,তার ফাঁকে একগুচ্ছ কালো মেঘের আবাস।জাঙ্গালিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে বলাকা বাসে বরুড়ায় পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। বাসের ঘোলা জানালায় তমস্যার প্রতিচ্ছবিতে জলমল করে দূরের ধান ক্ষেতের আবছা মায়া।বাঁশঝাড়ের ভেতর ঝিঁঝিঁদের মিটমিট জ্বলা শব্দ! জানালার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে দেখি বৃষ্টির গুঁড়ি গুঁড়ি শব্দ আমাকে ছুঁয়ে দেয়।উত্তরী বৃষ্টি হাওয়া ডুবিয়ে নেয় যেনো আমায় নৈসর্গিক কোনো এক অচেনা মায়ায়।বাস থেকে নামলাম।কোনো রিকশা নেই।৫কি.মি রাস্তা এই রাতের বেলায় হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর।অপেক্ষা করার পর মুগুজীর একটি অটো পেয়ে গেলাম।রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত।নিলীমার রঙে রাঙানো আকাশের তলে গাঁয়ের মেঠোপথের চিত্র যেনো বিমূর্ত ফর্সা চাদর।মুগুজী বাজার এসে নামলাম।বাজারের পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে আমাদের বাড়ি প্রায় আড়াই কিলোমিটার (মাঝখানে দুটি গ্রাম)।মেঘের গর্জন,বিদ্যুৎ চমকানোর আলো সাথে করে হাঁটা ধরলাম, পাশে কেহ নেই।রাজামারা গ্রামের পূর্ব পাশে সারি সারি তালগাছ।বাতাসে মরমর শব্দে কথা বলছে।এখান ক’মিনিট দাঁড়ালেই দখিনা বাতাসে গা এলিয়ে যাবে স্বর্গসমুদ্দরে।না আমি দাঁড়াইনি।তবে দখিনা বাতাসে স্বর্গসমুদ্দর টের পাচ্ছি!নিস্তব্ধ আলো।পাতা নড়া মরমর বাতাস।কি যে অদ্ভূত সুন্দর! সাথে কিছুটা ভয়।হাঁটতে হাঁটতে এগুচ্ছি, মনে হচ্ছে অনেক লম্বা রাস্তা!সেদিন বুঝলাম একাকিত্বের রাস্তা আসলেই খুউব সহজে শেষ হয় না।বৈরাগী বাজারের(বর্তমান মহেশপুর পুরাতন বাজার) কাছাকাছি চলে এসেছি।এই বাজারের পূর্বে এসে রাস্তার দক্ষিণ পাশেই আমিরাপুকুর।আগের যুগে এই পুকুরে ভেসে উঠতো স্বর্ণ-পিতলের বাসন-কোসন ।মানুষ এই রহস্যময় থালা-বাটি দিয়ে ৭গ্রামের মানুষ দাওয়াত দিয়ে জেফতের অনুষ্ঠান করতো (মৃতব্যক্তির রুহানির উদ্দেশ্যে ৪/৪০দিনের অনুষ্ঠান)। একদিন একটা বাসন চুরি হওয়াতে এর পর থেকে সেই স্বর্ণ-পেতলের ভাসন-কোসন ভেসে উঠেনি।এই রহস্যময় গল্প মা-নানিদের মুখে বহুবার শুনেছি।
এই পুকুরের পশ্চিম পাশেই আমাদের বংশীয় কবরস্থান।এখানে দাদা-দাদীসহ বংশের অনেক মানুষের সমাধি।(বর্তমানে বাবার কবরটাও এখানে পশ্চিমে একটি তালগাছের তলে)।হাটতে হাটতে
চলে এসেছি আমাদের কবরের পাশে।বাজারে ডুকতেই হাসি দিয়ে আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো বাবা।আমিতো হতবাক!বাবা বাজারের পুলের গোড়ায় বসে ছিলো।আমার জন্য সেই সন্ধ্যা থেকে টর্চলাইট হাতে অপেক্ষা করছিলো।অথচ সেইদিন বাবাকে কিংবা পরিবারের কাউকেই আমি বলিনি আমি বাড়ি আসবো।
এখনো ভাবি-বাবা কি করে বুঝলো-আমি সেদিন বাড়ি আসবো!
লেখকঃ আলোকচিত্রী।
আরো পড়ুন