ইচ্ছা জগতের আদ্যপান্ত
।। নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী ।।
প্রতিটা মানুষের একটি ইচ্ছা জগত থাকে। এমন একটি জগত যা শুধুই তার নিজের। কারো কারো জন্য সে জগতটা খুব কাছের, কারো জন্য অনেক দূরের কিছু। কেউ হয়তো বেঁচেই থাকে তার ইচ্ছা জগতের আবেশে, কেউ হয়তো কখনো বুঝতে পারেনা, ‘এমন কিছু কি আছে !’ তা ভেবে। এই যে পাওয়া না পাওয়ার এক বিচিত্র বিভেদ মানুষ নিজের মধ্যে ধারণ করে চলেছে, সেখানেই পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে তার ব্যক্তি সত্তা। আরে সেই সত্তাকে ছুঁয়ে দেখার, গড়ে তোলার, নিজের মত করে সাজানোর চেষ্টা যে মানুষ গুলো করে থাকে, তাদেরই আমরা সৃজনশীল হিসেবে আভরিত করি। আর সেই বোধ সত্তার উন্মেষেই সৃষ্ট আমার লেখক সত্তার। যেখানে আমি খুঁজে নিয়েছি আমার ইচ্ছা জগতের ক্যানভাস।
আলোর সরল পথ যেমন একপেশে গতিতে চলে তার মাঝে যদি একটি প্রিজমের স্থান হয়, তখন তা বর্ণিল চ্ছ্বটা হয়ে প্রকাশিত হয় অপর পাশে। একজন লেখকের কাছে মন হলো সেই প্রিজমের মত। তিনি তার বাহ্যিকতায় মনে গেঁথে নেন কালান্তরের বর্ণিলতা। আর সেই রৌদ্রজ্বল আলোকে ধারণের নেশাতেই যেন আমার লেখক হয়ে ওঠা। গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আবহেই, যেখানে ইচ্ছা জগতে বেঁচে থাকার মত মানুষকে দেখেছি সামনে থেকে। মানুষটি আমার বাবা, তার নিজস্বতার মাঝে যে আনন্দের উপভোগ, তা আমাকে চিনিয়ে দেয় এক নতুন জগতের সাথে। তাই যখন বয়সটা কৈশোরের আমি দেখতে পাই আমার নিজের একটি জগতকে। যেখানে আমি নিজে নিজেই গড়তে থাকি একেকটি চরিত্র। তারা নিজেরা গল্প বলে যেতে থাকে আমার কাছে। মনে হয়, চরিত্র গুলো তাদের জগতে আছে, আমি শুধু তাদের দেখছি, আনন্দ নিচ্ছি, কষ্ট নিচ্ছি। আর সেখান থেকেই উঠে আসে আমার গল্পের পরিব্যাপ্তি।
শুরুটা হয়েছিলো একেবারে কৈশোরে সায়েন্স ফিকশন লিখে। ছাপার অক্ষরে নিজের বানানো জগতটিকে দেখার আগ্রহ বুঝতে পেরেছিলেন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক অধ্যাপক আবদুল ওহাব স্যার, প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গল্প কুমিল্লার ঐতিহ্য বাহিক দৈনিক রূপসী বাংলায়। এরপর, ছোট ছোট শব্দ কথার বুননে রচিত অল্প কথা গুলো গল্প হতে থাকলো। একদিন দেখলাম সেগুলো বই হয়ে প্রকাশিত হয়ে গেল। প্রথম বই প্রকাশের আনন্দ তাই আমাকে যেমন আনন্দিত করছিলো একই সাথে শংকিত করছিল, আমার জগতটি সবার সামনে এসে গেলো না তো, খুব তাড়াতাড়ি? আর সেখান থেকেই আমার নতুন আবিষ্কার, আমার ইচ্ছা জগতের পরিব্যপ্তি।
আমি দেখতে পেলাম, আমার সেই জগতটি আসলে আমার নয়। সেই জগত হলো মহাকালের, যার স্রোতধ্বনিতে উঠে আসছে নানান গল্প। আমি যেমন বর্তমানে নিজেকে পাচ্ছিলাম, তেমনি পাচ্ছিলাম অতীতে। যেন কালস্রোতের ঢেউ আমাকে অতীত থেকে ভবিষ্যতের পরিভ্রমণে নিয়ে যায়। আমি আবিষ্কার করি, সব চরিত্রই আমার, সব গল্পই আমার। আবার সেই সব গল্প যখন অন্যের হাতে যায় তখন আমিও হয়ে যাই গল্প। পাঠকের কাছে আমি মূল্যায়িত হই, আর মনে হয়, এই জগতে হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকা যায়।
সময়ের প্রবাহে আমি বুঝতে পেরেছি, আমার বলার কিছু আছে, জানার এবং জানানোর কিছু আছে। সেই সাথে অনুভব করতে পেরেছি একেকটি চরিত্রকে, যারা আমার হয়ে কিছু বলে যায়, রেখে যায় আমারই কোন চিহ্ন। আমি অনুভব করতে পারি, আমার ইচ্ছা জগতে আমিও একটি চরিত্র। আমি যে গল্প বলি সেখানে আমার গল্পও বলি। এই যে নিজের জগতকে চেনা আর সেখানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া আর তার মাধ্যমে একেকটি চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণ করার ইচ্ছা আমাকে লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছে। লেখক হতে হতেই হয়ে উঠছি একেকটি গল্পের চরিত্র। হয়ে উঠছি আমার মধ্যে অন্য কেউ। আর বুঝতে পারছি আমরা সবাই একেকটি গল্প, আবার সব গল্প মিলে রচিত হচ্ছে একটি গল্প। আর সেই গল্প লিখে চলেছে মহাকাল, শত সহস্র বছর ধরে। কালান্তির ঢেউ পাড়ি দিয়ে গল্প প্রবাহিত হচ্ছে নির্মল প্রবাহে, অচেনা পাঠকের কাছে।
লেখক: কথা সাহিত্যিক। ডেপুটি সিভিল সার্জন,কুমিল্লা।